ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের প্রবাসী যুবক গাজী জাকির হোসেনকে (৩০) নিজ কক্ষে গলা কেটে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। হত্যার পর সিন্ধুকে থাকা জাকিরের দেড় লাখ রিয়াল নিয়ে গেছে খুনিরা। গত বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টার দিকে সৌদী আরবের হাইলোজারা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত জাকির উপজেলার অরূয়াইলের ধামাউড়া গ্রামের গাজী কাঞ্চন মিয়ার ছেলে। জাকিরের আয় রোজগারে ঈর্ষান্বিত হয়ে অরূয়াইলের কতিপয় ব্যক্তি পরিকল্পিত ভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ নিহতের বড় ভাই দুলালের। খুনিদের সনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা চেয়েছেন নিহতের পিতা মাতা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে জাকির চতুর্থ। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিল। এরপরই ভাইয়েরা মিলে আজ থেকে ১২ বছর আগে জাকিরকে সৌদী আরব নিয়ে যান। এরমধ্যে মাত্র দুইবার দেশে এসে গেছেন জাকির। প্রথম দিকে কষ্ট করলেও ২-৩ বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়ে যায় সে। সেখানের ৪-৫টি কোম্পানীর শ্রমিক দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তার। নিজের আত্মীয়স্বজন ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক নিয়ে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। গত কোরবাণির ঈদের আগেও ৬০ জন লোক নিয়েছেন। তার দ্বারা দেশের অনেক লোক উপকৃত হতো। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় ছিল তার। পরিবারের সবকিছুই দেখাশুনা করত জাকির। সৌদী আরবে বসবাসরত ধামাউড়া গ্রামের নজরূল (৩২) মুঠোফোনে জানায়, জাকির সহ তার কক্ষে ৪ জন বাংলাদেশী থাকতেন। সেই দেশের বিভিন্ন কোম্পানীতে কাজের শ্রমিক দিতেন জাকির। বুধবার ভোর পাঁচটায় সকলেই কাজে চলে যায়। জাকির কোথাও যায়নি। কারণ ওইদিন সকাল ১১টার দিকে তার বন্ধু রাসেলকে নিয়ে এক কোম্পানীর মালিকের সাথে দেখা করার কথা ছিল। সেই জন্য রাসেল জাকিরকে একাধিকবার ফোন দেয়। কিন্তু ফোন রিসিভ করেনি জাকির। বাধ্য হয়ে রাসেল জাকিরের খবর নিতে চলে যায় বাসায়। জাকিরের কক্ষের দরজা বন্ধ। বাহির থেকে রাসেল জাকিরকে অনেকবার ডেকেছেন। কিছুতেই ভেতর থেকে কোন সারা মিলছে না। পরে ২-৩ জন বাংলাদেশী প্রবাসীর সহযোগিতায় দরজা ভেঙ্গে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে তারা। বিভৎস্য নির্মম দৃশ্য। বাকরূদ্ধ হয়ে কেঁপে ওঠেন তারা। জাকিরের গলাকাটা রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। বাহিরে পড়ে আছে জাকিরের নাড়িভুরি। তারা চিৎকার করতে থাকেন। ঘটনাস্থলে জড়ো হয় আশপাশের বাংলাদেশীরা। তারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে জাকিরের লাশ নিয়ে যায়। বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আশপাশের কক্ষে বসবাসকারী কয়েকজন বাংলাদেশীকে আটক করেছেন। জাকিরের বড় ভাই দুলাল গাজী বলেন, জাকিরকে ২০০৮ সালের শেষের দিকে অনেক কষ্টে বিদেশ নিয়েছিলাম। পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সেই জাকিরের টাকায় চলত পরিবার। বিভিন্ন কোম্পানীতে শ্রমিক দেওয়ার ঠিকাদারী করে ভাল টাকা পয়সা আয় করেছিল। সৌদীতে জাকিরের ভাল অবস্থা সহ্য করতে পারেনি অরূয়াইলের কতিপয় লোক। তারাই পরিকল্পিত ভাবে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে আমার ভাইকে খুন করেছে। খুনিদের চিহ্নিত করে দ্রƒত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা চেয়েছেন দুলাল। নিহত জাকিরের পিতা গাজী কাঞ্চন মিয়া (৬০) কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। আমার ভাগ্যে এমনটা ঘটবে। কখনো ভাবিনি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। বাবা এখন লাশ হয়ে দেশে আসবে বলেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি।
বিয়ের স্বপ্ন পূরণ হলো না জাকিরের: পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বিয়ে করেনি জাকির ও তার ছোট ভাই। জাকিরের স্বপ্ন ছিল পিতা মাতা ও ভাইদের পছন্দের পাত্রি বিয়ে করবে। পাত্রীও পছন্দ করাছিল। পাত্রীর বাড়ি পার্শ্ববর্তী গ্রাম পাকশিমুলে। আগামী রোববার দিন বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার কথা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকা জাকির দিন গুণছিল। পরিবারের সকলেরও ইচ্ছে ছিল ভাল ও সুন্দর পাত্রী দেখে জাকিরকে ধূঁমধাঁমে বিয়ে করাবেন। নিয়তি কেঁড়ে নিল সব। মূহুর্তের মধ্যে জাকির ও তার গোটা পরিবারের স্বপ্ন ধূলোয় মিশে গেল। বিয়ের স্বপ্ন অপূরণীয়ই রয়ে গেল জাকিরের।
মা বাবার দেখা মিলল না: সর্বশেষ ছুটি কাটিয়ে যাওয়ার পর আর আসেনি জাকির। বিয়ের তারিখ ঠিক হলে আসবে। অসুস্থ মা বাবাকে দেখবে। দীর্ঘদিন পর ছেলে আসছে। এমন খবরে খুই খুশি ছিলেন জাকিরের মা। অনাকাঙ্খিত মৃত্যু জাকিরের সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। জাকির চলে গেছে না ফেরার দেশে। কিন্তু এর আগে শেষ দেখা হল না মা বাবার সাথে।
বাড়িতে চলছে শোকের মাতম: জাকিরের আসা ও বিয়ে নিয়ে যখন গোটা পরিবারে চলছিল আনন্দ উল্লাস। ঠিক সেই সময়ে জাকিরকে গলা কেটে হত্যার খবরে ভূমিকম্প শুরূ হয়েছে পুরো বাড়িতে। গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, বাসভবনের ভেতরে ও বাহিরে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের গড়াগড়ি। কান্না ও আহাজারির শব্দে কাঁপছে আকাশ বাতাস। ভারী হয়ে ওঠছে সেখানকার পরিবেশ। শুধু পরিবার নয়। সমগ্র গ্রামেই চলছে শোকের মাতম। বাকরূদ্ধ পিতা কাঞ্চন মিয়া ফেলফেল করে তাকিয়ে চোখের জলে ভাসছেন। প্রতি মূহুর্তে সক্সঘাহীন হয়ে পড়ছেন মা হাজী নূরজাহান বেগম (৫৫)।