যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব। যদি কেউ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় তবে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাহস নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে ডেঙ্গুকে। তাদের সবার আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তবেই কমে আসবে মশার উপদ্রপ।
করোনা ভাইরাস, সারা বিশ্বে এখন আতঙ্কের নাম। আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন এক চ্যালেঞ্জও। করোনা নামক একটি ভাইরাস বিশ্ববাসীকে সেই চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই যেন প্রতিদিন, দিন পার করছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। এর বিরূপ প্রভাবে থমকে গেছে প্রায় ছয়শ কোটি মানুষের জীবনযাত্রাও। দেশে দেশে চলছে লকডাউন ও কারফিউ। বন্ধ রয়েছে অনেক দেশের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কঠিন এমন অবস্থা থেকে বিশ্ববাসী কবে নাগাদ মুক্তি পাবেন তা কেউ বলতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। তাই করোনাভাইরাস বিষয়ে সবার মধ্যে কাজ করছে ভয়। আপাতত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকাটা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। তাই সেই পথেই হাঁটছে পুরো বিশ্ব। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
এমন খবরে সবার মধ্যে কাজ করছে অস্বস্তি ও ভয়। অস্বস্তি রয়েছে বেশকিছু জায়গায়। কেননা, করোনাভাইরাসের পাশাপাশি আরও একটি রোগ আমাদের সামনে চলে এসেছে অনেকটা নীরবে। যা গত কয়েক বছর ধরে আমাদের ভীষণভাবে ভোগাচ্ছে। সেটা ডেঙ্গু। আমাদের দুর্ভাগ্য করোনাভাইরাসের মধ্যে অনেকটা নীরবে আসছে ডেঙ্গু। করোনা আসার আগে গত কয়েক বছর মানুষ ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে। এ সময় মারাও গেছেন অনেক মানুষ। এবারও ডেঙ্গু সবার মধ্যে ধীরে ধীরে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এখানে সবচেয়ে শঙ্কার জায়গাটা হলো অনেকে জ¦র-কাশি নিয়ে করোনা টেস্ট করার পর দেখেন রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এখানে করোনা থেকে বেঁচে যাওয়ার আনন্দ মনে কাজ করলেও অন্য জায়গায় আতঙ্ক থেকেই যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ডেঙ্গু টেস্ট করানো হচ্ছে। তাই এ সময়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ডেঙ্গুর কথা ভুলে গেলে চলবে না। এ বিষয়ে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশে ডেঙ্গু এখন আর কোনো নতুন রোগ নয়। পুরনো হয়ে গেছে। ডেঙ্গু বিষয়ে এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। আমাদের দেশে সাধারণত এপ্রিল মাসকে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরুর মাস ধরা হয়। আর শেষ হয় জুলাই-আগস্টে। কিন্তু গত দুই বছর আর এই সময়সীমা মানেনি ডেঙ্গু। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ব্যাপকতা ছিল অনেক বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল অক্টোবরের পর ডেঙ্গু আর ছড়াবে না। তবে সেই তথ্য মিথ্যে প্রমাণ করে ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর ছিল প্রায় সারা বছর জুড়েই। এবারও বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু বিষয়ে সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে। কারণ ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহক হলো এডিস মশা। আর এডিস মশা বিভিন্ন পাত্রে বৃষ্টির পানির মধ্যে ডিম পেড়ে বংশ বৃদ্ধি করে। এবারও বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেন করা হচ্ছে- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সংখ্যা বৃদ্ধিই প্রমাণপত্র। ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের সঙ্গে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত বছর ডেঙ্গু প্রায় প্রাদুর্ভাবের আকার ধারণ করেছিল। এবারও তেমন কিছুর শঙ্কায় রয়েছে মানুষ। যা করোনার মতো এমন কঠিন সময়ে সত্যিই ভয়ের খবর। তাই এ বিষয়ে এখনই বাড়তি সর্তকতা জরুরি।
সাধারণত তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি অতি বৃষ্টির কারণে জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয় এডিস মশা। বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশার প্রজননও বেড়ে যায় এ সময়ে। এখন বৃষ্টিও বেশি হচ্ছে। তাই এডিস মশার প্রজনন শুরুর সময় এখনই শুরু হয়ে গেছে। যা ভাবনার বিষয়। পাশাপাশি রয়েছে আরও কারণ। অবশ্য এর জন্য আমরা সবাই দায়ী। আমরা শহরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো দখল-দূষণে জর্জরিত করে তুলছি। কিছুকিছু খাল রয়েছে সেগুলো যেন এক একটি মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। এসব জলাধারগুলো পরিষ্কার করার বিষয়ে কেউ খুব একটা উদ্যোগী নয়। তাই পরিবেশগত অব্যবস্থাপনার কারণে ডেঙ্গুর সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। যদি পরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরের জলাধার রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা রোধ, প্রকৃতি রক্ষা, দূষণ রোধের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া যায় তবে অনেকাংশে কমে যাবে এসব সমস্যা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কার্বন নিঃসারণ বিশেষ অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে ডেঙ্গু বিস্তারে। এর জন্য এমন বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সবুজের বিকল্প নেই। কেননা, ব্যাপক বনায়নই পারে কার্বন নিঃসারণ রোধ করে প্রকৃতির বৈরিতা থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করতে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিমাণ সবুজ থাকার কথা এর বিপরীতে আছে সামান্যই। কার্বন নিঃসারণ হ্রাস করে প্রকৃতিকে প্রকৃত বন্ধু করে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য প্রয়োজন আমাদের চারপাশকে সবুজে শ্যামল করে তোলা। এর ফলে সব দিক দিয়ে লাভবান হবে মানুষ।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখানে সংশ্লিষ্ট কৃর্তপক্ষেরও কিছু বাড়তি দায়িত্ব রয়েছে। ঢাকায় ডেঙ্গু বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় দায় অবশ্য দুই সিটি করপোরেশনের। গত কয়েক বছর ধরে মশা নিধনের ক্ষেত্রে আহামরি কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। তাই সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে এখনই দ্রম্নত ও কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করতে দেয়া যাবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা রোধ করতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশন নয়, নাগরিক হিসেবে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ¦র প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ। পাশাপাশি এ মশা যেন কামড়াতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের নাগরিক জীবনের অনেক সমস্যার মধ্যে মশার উপদ্রব একটি প্রধানতম সমস্যা। মশা একটি ছোট্ট কীট হলেও মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। এখানে মজার বিষয় হলো মশা নির্মূলে প্রতি বছর ব্যাপক বাজেট হয়। আলোচনা-সমালোচনাও কম হয় না এ বিষয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না। শুধু রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে আতঙ্কের পরিমাণও বাড়ে। এখন মশা নির্মূলে শুধু ওষুধ প্রয়োগ করলেই হবে না। পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাতে হবে। এ ছাড়া জনগণের দায়বদ্ধতা ও সচেতনতাও প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের পক্ষে মশা নির্মূলের সবটুকু দায়িত্ব পালন করা হয়তো সম্ভব নয়। এখানে অবশ্য সাধারণ মানুষের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব। যদি কেউ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় তবে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাহস নিয়ে মোকাবিলা করতে হবে ডেঙ্গুকে। তাদের সবার আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তবেই কমে আসবে মশার উপদ্রপ।
সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক