কোরআন ও হাদিসের আলোকে দোযখের যে আলামত বর্ণনা করা হয়েছে, আমাদের দেশের জেলখানার নিষ্ঠুরতার মাঝে এর আলামত, গন্ধ ও বাতাস অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায়। তদোপরি কয়েদি হিসেবে জেলখানায় না গিয়ে বাহিরের দৃশ্যপট দেখে জেলখানার দুর্বিসহ নিষ্ঠুর অমানবিক জীবন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো কিছু বলা বা লেখালেখি কোনোমতেই তাৎপর্যপূর্ণ না হওয়ারই কথা। তবে জেলখানার বিষয়ে কোনো কিছু লেখতে, বলতে এবং আলোচনা-সমালোচনায় আনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জেলাখানার ভূক্তভোগীর নিদারুন দুঃসহ বেদনা, কষ্ট, জ্বালা ও নিষ্ঠুরতার তর্পন।
জেলখানা বা কারাগার সম্পর্কে যারা এ পর্যন্ত বিভিন্ন বই পুস্তক লিখেছেন বা স্মৃতিচারণ করেছেন সবকিছুই তাদের বন্দী জীবনের বাস্তবতার স্মৃতি তর্পন ও নিষ্ঠুরতার দলিল (উড়পঁসবহঃধৎু ঊারফবহপব)।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৭/৭/২১ ইং মঙ্গলবার জাতীয় পাবলিক দিবস ও জনপ্রশাসন দিবস পদক ২০২০ ও ২১ উদযাপন উপলক্ষে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্স ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যোগদান করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে দৃপ্ত কন্ঠে বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের শাসক নয়, সেবক হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ গর্ভনমেন্ট অব দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বা জনগণের সেবক। প্রধানমন্ত্রীর এ বাস্তব উচ্ছাসের প্রতিফলন প্রশংসিত। কিন্তু জেলখানাসহ অন্যান্য স্তরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এটাকে স্বাধীনতার পর থেকে কোথায় নিয়ে গেছে তা ভাবতে গিয়েও অবাক হতে হয়। যাদের মধ্যে অনেক সময় মানবতার লেশমাত্র দেখা যায়নি। বরং ওরা মানুষের ওপর অত্যাচার ও জমিদারতন্ত্রের তাবেদারির ন্যায় নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার চিত্র অহরহ ভেসে ওঠে। নিষ্ঠুরতার এ চিত্র জেলখানাসহ শাসন প্রশাসনের সব জায়গাতে লক্ষ্য করা যায়। যা থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ পরাহত।
এ প্রসঙ্গে ২৮ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত “দুর্নীতির মহাচক্রের জিম্মি কারাগার” প্রতিবেদনটি দৃষ্টিতে এসেছে। সেদিকে যাওয়ার আগে নিজের জীবনে দেখা জেলখানার নিষ্ঠুরতার কিছু কথা না বললেই নয়। যা আমার কাছে দোযখের গন্ধ, বাতাস ও কোরআন হাদীসের বর্ণনার কথা বারংবার মনে হয়েছে। তাই বলে আমি দোযখের আজাবের সাথে কোনো অবস্থাতেই তুলনা করতে চাচ্ছি না। দোযখের নিষ্ঠুরতার শেষ নেই। যে আগুন দিয়ে রান্নাবান্না ও কাজ করা হয় এই আগুন দোযখের আগুনের তুলনায় কিছু নহে। এই আগুন নাকি দোযখের আগুনের সাথে তুলনাই চলে না।
১৯৭৪ সালে আমি ভাসানী ন্যাপের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পরবর্তী সময় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এছাড়া সেই সময় মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতা ও সৈয়দ ইরফানুল বারী কর্তৃক সম্পাদিত সাপ্তাহিক হককথা এবং আবু নাসের খান ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রাচ্যবার্তার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। তদোপরি ১৯৮০ সালে কিশোরগঞ্জ থেকে নতুন দেশ নামে আমার পৃষ্ঠপোষতা ও সম্পাদনায় একটি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়ে থাকে। হককথা টাঙ্গাইলের সন্তোষ ও প্রাচ্যবার্তা ১২৬, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৪ সালের ৩রা নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ডাকে ভূখা মিছিলে অনেকের মতো আমিও যোগদান করি। তদানীন্তন কিশোরগঞ্জ মহকুমার পাকুন্দিয়া থানার একটি ভূখা মিছিল থেকে আমার সাথে আরও অনেককে গ্রেফতার করে কিশোরগঞ্জ সাব কারাগার বা জেলখানায় প্রেরণ করা হয়ে থাকে। সেই সময় জেলখানার গেইট থেকে শুরু করে অনেক অভূত পূর্ব দৃশ্যের অবতারণা চোখে পড়ে। যা ইতোপূর্বে কখনও দেখি নাই। জেলার বড় জমাদার (বড় বাবু) ছোট জমাদার (ছোট বাবু), কারারক্ষী (মিঞাসাব), গেইট ম্যাড, বিকেলাস, ফালতু, চৌকার ম্যাড, কম্বল প্যারেড, পানি ভর্তি ড্রাম ও বালতি ধোলাই, কারা সিআইডি, আমদানী ওয়ার্ড, ১ নং, ২ নং, ৩ নং ও ৪ নং ওয়ার্ড। যেহেতু এখন থেকে প্রায় ৪৭ বছর আগের ঘটনা তাই অনেক কিছু অকপটে ভুলে গিয়েছি। তখন কিশোরগঞ্জ জেলার সাব কারাগারসহ অন্যান্য সাব কারাগারে কোনো ডিভিশন বা ফাঁসির ব্যবস্থা ছিল না। এসব ছিল ময়মনসিংহ জেলাখানায় বা কেন্দ্রীয় ও অন্যান্য জেলা কারাগারে। তখন অনেক কয়েদীকে কিশোরগঞ্জ কারাগারে ১ নং, ২ নং, ৪ নং ওয়ার্ডে রাখা হত। মহিলা ওয়ার্ড সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। অপর দিকে রাজনৈতিক কয়েদীসহ অনেককে ৩ নং ওয়ার্ড এবং ১ নং, ২ নং আলাদা সেলে রাখা হত। যা সংক্ষিপ্ত কলামের কলেবরে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা- গেইট ম্যাড হচ্ছে জেলখানার চামচা, খয়ের খা ও প্রভুদের তল্পীবাহক। যাকে দিয়ে জেলখানার সব উদ্দেশ্যসাধন করা হয়। বিকেলাস হচ্ছে জেলখানার এক শ্রেণীর অবাধ্য কয়েদী। ফালতু সামান্য অর্থ ও খাওয়া দাওয়ার বিনিময়ে কয়েদীদের কাজকর্ম করে থাকে। এক শ্রেণীর কয়েদী বাহির থেকে হাত পা ভাঙা অবস্থায় জেলখানায় আসার পর পুরাতন কম্বল প্যাচিয়ে টানাহেচড়া, জামব্যাক ও আইওডেক্স মালিস। যাকে কম্বল প্যারেড বলা হয়। পানি ভর্তি ড্রাম বা বালতি ধোলাই বলতে বুঝায় যারা প্রথমে কয়েদী হিসেবে জেলে ঢুকত তাদেরকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ড্রাম দিয়ে পানি সরবরাহ ও কূয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি উঠানো। এগুলো ছিল জেলে অপরিসীম ও নিষ্ঠুরতা। যা হাবিয়া দোযখের বাতাস, গন্ধ ও আলামত হিসেবে পরিগণিত। ব্রিটিশ রচিত ১৯৩৮ সালের জেল কোড অনুসারে এসব দুর্বিসহ জ্বালা যন্ত্রনা পরিলক্ষিত হলেও বর্তমানে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে জেলখানার ভেতরে পেমেন্ট করে ক্যান্টিন থেকে আলাদা অনেক কিছু কেনা যায়, ফ্যানের ব্যবস্থাসহ পত্রপত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানা যায়। সেই সময় লাইন ধরে বাথরুমের অবর্ননীয় ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে নাকি অবস্থার অগ্রগতি হয়েছে।
প্রথমদিন জেলার আঃ আওয়ালের নির্দেশে বড় জমাদার আলী আহমদ ম্যাডকে আমদানী ওয়ার্ডে আমাকে রাখার ব্যবস্থা করে। আমার সাথে যা ছিল জেলে ঢুকার সময়ই অন্যান্যদের মতো গেইট অফিসে জমা রাখা হয়ে থাকে। যারা আমার মতো নতুন কয়েদী তাদেরকে আমদানী ওয়ার্ডের ম্যাডের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয় যারা টাকা দিবে বালতি দিয়ে পানি উঠানো ও ড্রামভর্তি পানি ওয়ার্ডে নিতে হবে না। যারা টাকা দিবে জেলখানার চৌকা থেকে স্পেশাল রুটি, বেশী ভাত ও তরকারী বেশী করে দেয়া হবে। টাকা দিলে ভালো ওয়ার্ডে থাকাও ফুট ফরমায়েশ, শরীর টিপা, কাপড় চোপড় ধোয়া, গোসলের পানির ব্যবস্থা ও চৌকা থেকে খাবার আনার জন্য ফালতু দেয়া হবে। অপর দিকে বাহির থেকে সাক্ষাৎপ্রার্থী এবং কোনো পরিদর্শন টিম (ঠরংরঃড়ৎ) আসলে নিজের কোনো সমস্যা তাদের কাছে কোনো অবস্থাতেই বলা যাবে না। অর্থাৎ বলতে হবে সবকিছু ঠিকঠাক এবং আমরা সবাই (কয়েদী) ভালো আছি। তাছাড়া কর্তৃপক্ষের জেলখানার ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। জেলখানায় কোনো পরিদর্শন আসার আগেই জেল কর্তৃপক্ষ ও ম্যাডরা কয়েদীদেরকে জানিয়ে দিত। তাদের কাছে কোনো সমস্যা বললে তাদেরকে জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হবে, ডান্ডাভেরী পড়ানো হবে এবং ভেতরে পায়খানার পাশে রাখা হবে। এমনিভাবে কারাগারের অব্যবস্থাপনা ও নিষ্ঠুরতার যেন শেষ ছিলনা। আর সেই সময় কারারোগীদের সবরোগের জন্য ছিল এন্টাসিড, প্যারাসিটামল, আয়রন ট্যাবলেট ও সালফাগুয়েন আইডিন। এই ঔষধগুলোর বাইরে জেলের ভেতর কয়েদী কম্পাউন্ডারকে আর কোনো ঔষধ দিতে দেখা যায়নি। তদোপরি কম্পাউন্ডারেরও চিকিৎসার ব্যাপারে তেমন কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে না।
সেই সময় ডালে কাংকর ও পোকা যেমন লেগে থাকত, তেমনি ভাত, আটার রুটি ও দুর্গন্ধময় পুরান গুড় বা লাল চিনি খাওয়ার আদৌ কোনো যোগ্য ছিল না। তারপরও কয়েদীরা তা খেলেও প্রায় সময় জেলখানার ভাত দিয়ে জেলার ও জেলের তত্ত্বাবধায়ক মহকুমা প্রশাসকের গাভী মোটাতাজা করা হত। এমনকি জেলের কয়েদী বাগানী দিয়ে জেলার মহকুমা প্রশাসক ও আরও অনেকের কাজকর্ম করানো হত। অর্থাৎ যাদের কয়েদী জীবনের জেলখাটা প্রায় শেষ ওরাই সাধারণত বাগানী হিসেবে কাজ করতো।
এ নিবন্ধে প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে ২৮ জুলাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা। যেদিকে বিশদ বর্ণনায় না গিয়ে প্রতিবেদনটির কিছু কথা উল্লেখ করা হল। যার বেশীর ভাগই ছিল কুষ্টিয়া জেলখানাসহ অন্যান্য জেলখানার অব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে। জানা যায়, দুবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সুরক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে কারা অধিদপ্তরের সব পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা আহবান করার সুপারিশও করা হয় তদন্ত রিপোর্টে। এমনকি এই সভায় যে ১৯টি সুপারিশ করা হয়েছিল তার অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। সুপারিশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক দফা তাগিদ দিয়েও কাজ হয়নি। এমনকি মন্ত্রণালয়ের কমিটি সাফ জানিয়ে দেয় প্রতিটি কারাগারেই চলছে ভয়াবহ অনিয়ম দুর্নীতি। তদোপরি সংকট নিরসনে সচিবের সভাপতিত্বে সভা করার কথা থাকলেও তা আজও হয়নি।
সূত্রে আরও জানা যায়, জেলখানার ক্যান্টিন সংক্রান্ত বেশীর ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। পিসি কার্ডের বাইরে নগদ টাকায় কেনাবেচা হয় বেশী। এছাড়া নির্ধারিত দামের বাইরে বেশী দামে খাবার ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করা হয়। দেশে মোট কারাগারের সংখ্যা ৬৮টি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ১৩টি এবং বাকি ৫৫টি জেলা কারাগার। প্রতিটি কারাগারে গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রী হয়। যদিও অফিসিয়ালি এই বেচাকেনা অর্ধেকেরও কম দেখানো হয়ে থাকে। প্রতিটি কারাগার থেকে লভ্যাংশের ৪০% পাঠানো হয় কারা অধিদপ্তরের তহবিলে। তবে এই অর্থ কোথায় কিভাবে খরচ করা হয় খঅজ ফান্ডের মতো অডিট হয় না। এছাড়া টাকা ভাগাভাগি নিয়ে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের মধ্যে সারা বছর অদৃশ্য দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। এক সময় কারা ক্যান্টিনের লভ্যাংশ টাকা কিছু কাজে লাগানোর জন্য গড়ে তোলা হয় পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্প, প্রিজনার্স অফিসার্স এসোসিয়েশন এবং প্রিজনার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি। কিছুদিন যেতে না যেতেই তা ভেস্তে যায়। আরও জানা যায়, রাজনৈতিক শেল্টারে গিয়ে এসব কিছু পরিকল্পনা, দুর্নীতি ও ভাগাড়ে পর্যবসিত হয়। যাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি।
জেলাখানায় অনেক কিছু সংস্কারের কথা শুনা গেলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের রচিত অনেক আইনের ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। যদিও জেল কর্তৃপক্ষ নতুন করে সংযুক্ত করেছে “রাখিব নিরাপদ দেখানো আলোর পথ”। কথায় নয়, বাস্তবে যাতে স্বাধীন দেশের কয়েদী হিসেবে জেলখানায় যে সেবা ও ব্যবস্থাপনার দরকার ইহাই কয়েদী হিসেবে বন্দী জীবনের প্রত্যাশা। অপর দিকে বলব, জেলখানার মিঞাসাব, ছোট বাবু, বড় বাবু, জেলার, জেলখানার সুপিরিয়র কোনো কর্মকর্তা, আমলা ব্রুক্রেটস ও ইঁৎবধঁপৎধপু কারও কাম্য নহে।
পরিশেষে বলব, স্বাধীন দেশের জেলখানায় পরাধীন ব্রিটিশ আমলের রচিত ১৯৩৮ সালের জেলকোড আর নয়। জেলখানাকে হাবিয়া দোযখের বাতাস, গন্ধ ও আলামতের মতো আর কেহ দেখতে চায় না। কথায় নয় বাস্তবে জেলখানা আসলেই হোক মুক্তপথের সুন্দর ও আলোর দিশারী।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট