কোন এক মনিষী বলেছেন, শিখে ভুলে না গেলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। কথাটা সর্বাংশে সত্যি। আমাদের দেশে যেহেতু ব্যাপাকভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেনি তাই আমাদের শিশু কিশোররা সত্যিকার অর্থে তেমন কিছু শেখার সুযোগ পায় না, তাই ভুলতেও পারে না। জন্মের পর থেকেই তারা শুধু মুখস্ত করার কৌশলটাই করায়ত্ব করে। স্কুল-কলেজের সীমাবদ্ধ গ-িতে তারা কুয়ায় আবদ্ধ ব্যাঙের মতো একটা খ-িত আকাশের দেখা পায় কেবল। সীমাবদ্ধ বইয়ের বাইরে তারা যেহেতু বিচরণ করে না, করতে পারে না, কিংবা করার সেই পরিবেশ পায় না, তাই তারা সুবিশাল আকাশে বাধাহীনভাবে বিচরণ করা থেকে হয় বঞ্চিত।
ইউরোপ-আমেরিকায় যেখানে রাস্তার মোড়ে, পার্কে, স্টেশনেÑসর্বত্র গনমানুষের জন্য বইয়ের সংগ্রহশালা থাকে উন্মুক্ত, সেখানে আমাদের দেশে থাকে চায়ের দোকান। তারা বাস কিংবা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যেমন বই পড়ে, তেমন বাস, ট্রেনে ওঠার পরও তাদের হাতে বই থাকে খোলা। বই পড়াটা তাদের একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। নানা রংবেরংগের বই তারা পড়ছে, আবার ভুলেও যাচ্ছে, কিন্তু সেই বই অলক্ষ্যে তাদের ভেতর তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে সুন্দর জীবনবোধ। বইয়ের এই এক কারিশমা। বই মানুষের হৃদয়কে উদ্বোধিত করে। বইয়ের সংস্পর্শেই মানুষ ধীরে ধীরে মানবিক হয়ে উঠে। হয়ে উঠে সভ্য।
আমরা আমাদের দেশে যেহেতু এমন বই-পড়া সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি, তাই আমাদের শিশু-কিশোরদের সুন্দর বোধ ও চেতনার বিকাশের জন্য স্কুল-কলেজের সীমাবদ্ধ অবদানটাই অমূল্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শিশু-কিশোরদের এই বোধের উন্নয়নের জায়গাটা মহামারী করোনার করাল থাবায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্থবির। স্কুল-কলেজের এই দীর্ঘ দিনের অচলতায় শিশু-কিশোররা মানসিকভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমাবদ্ধ গ-ির বাইরে আমাদের বই পড়ার অভ্যাস থাকলে ক্ষতিটা হয়তো বহুলাংশে কম হতো।
যাহোক, সুখের সংবাদ এই যে, আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ইতোমধ্যে স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন, যদিও তা সীমিত পরিসরে। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের মতামতও বর্ষিত হচ্ছে। কোন কোন মহাশয় টকশোতে এসে এমনও মন্তব্য করছেন, “আমরা কি আমাদের সন্তানদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি?” ভীষণ ভয়-জাগানিয়া প্রশ্ন। তবে দেশের অধিকাংশ মানুষই স্কুল-কলেজের খোলার পক্ষে। শিশু-কিশোরদের দীর্ঘদিনের মানসিক যানজট দূরীকরণে সরকারকে একটা সাহসী পদক্ষেপ নিতেই হতো। আমাদের সরকার দেরিতে হলেও ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছে, যদিও পুরোপুরি নয়। শিশু-কিশোরদের সুরক্ষার ব্যাপারটা নিয়ে কিছুকিছু মানুষ যতোটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন আমার মনে হয় না যে ব্যাপারটা ততো উদ্বেগজনক। স্কুল-কলেজের এই বন্ধের দিনগুলোতে কিন্তু শিশু-কিশোররা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘরবন্দি জীবন অতিবাহিত করেনি নিঃসন্দেহে। তারা যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছে। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করেছে। তাদের মা-বাবা’ও ঘরের বাইরে গেছেন, নানা কিসিমের মানুষজনের সাথে সাক্ষাৎ শেষে আবার ঘরে ফিরে এসেছেন। কাজেই, ঘরের ভেতরেও যে তারা এতোদিন খুব নিরাপদে ছিল, বা এখনো আছে এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। স্কুল-কলেজে গেলেই তারা আক্রান্ত হবে এমন ভাবনাটা মনে হয় অমূলক।
করোনা মহামারীতে আক্রান্তদের বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে অধিকাংশই প্রবীণ এবং যারা শারীরিকভাবে নানা জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন তারাই মূলত এর কবলে পড়েছেন। শিশু-কিশোরদের যেহেতু শারীরিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি, এবং তারা যেহেতু প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তাই তারা আক্রান্ত হয়নি বললেই চলে। কাজেই, সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-কানুন পালন করা হলে স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্তটা অকল্যাণকর হবে না। কাজেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার এই ব্যাপারটা যাতে কোন অকল্যাণ বয়ে নিয়ে না আসে সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই সতর্ক থাকতে হবে বেশি। সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদেরকেও।
একাডেমিক পড়াশুনার বাইরে অন্য কোন বই পড়াটাকে আমাদের বাবা-মা’রা নেকনজরে দেখে না। সীমাবদ্ধ বইয়ের বাইরে তাদের সন্তানদের হাতে অন্য কোন বই দেখলে তারা এমন আচরণ করেন যেন তাদের সন্তান কোন নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করছে। এই ধরণের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত। শিশু-কিশোরদেরকে তাদের ইচ্ছে মতো মনের রাজ্যে, বইয়ের রাজ্যে বিচরণ করতে দেয়াটাই কাম্য। বাবা-মা’দের এটা জেনে রাখা উচিত যে, অ্যাকাডেমিক বই মুখস্ত করে তাদের সন্তান বড়জোর বিসিএস ক্যাডার হবে, কিন্তু বই মুখস্ত না করে তাদের সন্তান হবে বড় কোন বিজ্ঞানী কিংবা বড় কোন সাহিত্যিক। তার চাইতেও বড় কথা সে হবে ভাল একজন মানুষ। কিন্তু আমাদের দেশে তো সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী আর ভাল মানুষের চাইতে ভাল চাকরিজীবীর মর্যাদা বেশি, মানুষ সে যেমনই হোক। আমাদের মানসিক দীনতাই এর জন্য দায়ী। সন্তানদেরকে ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চাইতে, ভাল চাকরিজীবী হিসেবে গড়ে তুলতেই আমাদের প্রাণান্ত চেষ্টা। আর এই কাজটা করতে গিয়ে অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেই দুর্বহ বোঝা। সন্তানদের মানসিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে, তাদেরকে নামিয়ে দেয় এ প্লাস পাওয়ার ইঁদুর দৌড়ে। সন্তান ভালো রেজাল্ট না করলে তাদের মান-সম্মান যেন আর থাকে না। আত্মীয় স্বজনের কাছে সন্তানের ভাল রেজাল্টের খবর শুনিয়ে আত্মতৃপ্তি নেয়ার বঞ্চনা তাদের উন্মাদ করে তোলে। সন্তানের পড়ালেখার ব্যাপারে তারা হয়ে উঠে কঠোর থকে কঠোরতর।
একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, যে মেয়েরা কখনো সীমাবদ্ধ গ-ির বাইরে বই কখনো পড়েনি, এমনকি অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার ক্ষেত্রেও যে বলতে গেলে ব্যর্থ, মা হিসেবে তারাই ভবিষ্যতে তাদের সন্তানদের ব্যাপারে অনেক রূঢ় হয়ে থাকে। স¤্রাট নেপোলিয়ন এজন্যই হয়তো বলেছিলেন, তোমরা আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটা শিক্ষিত জাঁতি দেবো। কেননা একজন শিক্ষিত মা হবেন উদার প্রকৃতির। তিনি তার সন্তানদেরকে ঔদার্যের শিক্ষা দেবেন। তার মনটাকে একটা বেড়াজালে বন্দি না করে, তাকে দেবেন অবারিত অন্তরীক্ষ। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার চাইতে তিনি অপ্রয়োজনীয়তাকেই গুরুত্ব দেবেন বেশি। কেননা পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর তা প্রয়োজনে নয়, অপ্রয়োজনেই তৈরি হয়েছে। আমরা প্রয়োজনে বাড়ি নির্মান করি, কিন্তু অপ্রয়োজনে তৈরি করি বাগান।
শিক্ষার প্রয়োজনীয় দিক হলো চাকরি। এর জন্যই দরকার মুখস্তবিদ্যা। দরকার স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। দরকার সার্টিফিকেট। আর শিক্ষার অপ্রয়োজনীয় দিক হলো আনন্দ আহরণ। শিক্ষার এই অপ্রয়োজনীয় দিকটাই মানুষকে সুন্দর করে তোলে। এই কাজটা করার জন্য স্কুল কলেজের দরকার হয় না। মুখস্ত বিদ্যারও দরকার হয় না। দরকার হয় বইয়ের। শিক্ষার এই অপ্রয়োজনীয় দিকটির কথা উপলব্ধি করেই বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও কবি প্রমথ চৌধুরি স্কুল-কলেজের চাইতে লাইব্রেরিকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তাঁর মতে লাইব্রেরির গুরুত্ব হাসপাতালের সমান, কিন্তু স্কুল-কলেজের চাইতে বেশি। তা এজন্যই যে হাসপাতাল যেমন মানুষের শরীরকে সুস্থ করে তোলে, ঠিক তেমন লাইব্রেরি মানুষের মনের সুস্থতার জন্য কাজ করে। পাঠক লাইব্রেরিতে ঢুকে তার পছন্দানুসারে বই বাছাই করে পড়তে পারে। ঘুরে আসতে পারে মনের রাজ্যে। কোন বাধা নেই, সীমা নেই।
করোনা’র এই সংকটকাল আমাদের এই শিক্ষাও দিয়ে গেলো যে, আমাদের শুধু শিক্ষার প্রয়োজনীয় দিক নয়, অপ্রয়োজনীয় দিকের প্রতিও গুরুত্বারোপ করতে হবে। শুধু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে হবে না, লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বই-পড়াটাকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মন যাতে পরিপুষ্ট খোরাক পায় সে ধরণের বইয়ের পরিবেশ তাদেরকে দিতে হবে। বইয়ের প্রতি তাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তারা যদি বইয়ের সংস্পর্শে থাকে, বই যদি তাদের সুহৃদ হয়ে উঠে, হয়ে উঠে তাদের আত্মার উন্মেষকারী, তাহলে স্কুল-কলেজের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতেও তারা মানসিকভাবে অপুষ্টির শিকার হবে না। তারা ধীরে ধীরে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে ভালো নাগরিক হিসেবে। তারা হবে দেশের সম্পদ। তাদের দ্বারা সরকারি সম্পত্তি লুট হবে না। তারা মানুষের ফাইল আটকে রেখে ঘুস গ্রহণ করবে না। তারা হবে সৎ। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে তারা কাজ করবে।
তবে এ কথাও সত্য যে, প্রয়োজনটাই যখন বড় হয়ে উঠে তখন অপ্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে মানুষের গুরুত্বারোপ হ্রাস পায়। তাই মনের চাহিদার চেয়ে আমাদের কাছে পাকস্থলীর চাহিদাটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি হয়তো একদিন বদলে যাবে। মানুষের লুপ্ত সৌন্দর্যবোধ ফিরে আসবে। ¤্রয়িমাণ আত্মা হয়ে উঠবে সজীব। এজন্য, সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে সবাইকে। অভিভাবকদেরকেও তাদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তনে মনোযোগী হতে হবে।
যাহোক, সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্কুল-কলেজ অবশেষে মুখরিত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সরকারের এখন উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও দ্রুত হলে নিয়ে আসা। সরকার অবশ্য সেই চিন্তাভাবনাও করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার দলের কেউ কেউ ছাত্রলীগকে ভূমিকা রাখার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। ছাত্রলীগ যেখানে প্রস্তুত থাকে সেখানে যে শুভ, অশুভ অনেককিছুই ঘটে যেতে পারে সে ব্যাপারে অবশ্য একটা ভাবনা থেকেই যায়। আমার মনে হয় সরকারকেও এ ব্যাপারে ভাবা উচিত।
তাহসিনুল ইসলাম : কথাশিল্পী