করোনার মহামারীতে প্রায় দেড় বছর পর গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সাথে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামে ভয়াবহ বাল্যবিয়ের চিত্র। অভিভাবক মহল বলছে দারিদ্রতা, যোগাযোগ বিচ্ছন্নতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছে জরিপ করে প্রকৃত বাল্যবিয়ে এবং শিশু শ্রমে যাওয়া শিক্ষার্থী সংখ্যা নির্ণয় করে ব্যবস্থা নেবার আশ^াস।
সারাদেশে ১২সেপ্টেম্বর খোলায় আনন্দ-উল্লাসে নিজ-নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসেন। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী নার্গিস নাহার। সে শ্রেণির ছেলে সহপাঠীদের সাথে একটি ব্রেঞ্চে একাই পাঠদানে অংশ নিয়েছে। আনন্দ মাখা মুখে সবাই যখন ক্লাস করে তখন নার্গিস নাহারের চোখে মুখে অদৃশ্য আতঙ্ক কাজ করছে। হাজারো দুশ্চিন্তায় হাসি মুখে ভরে ওঠে নার্গিসের মুখে মলিনতা। কিভাবে করবে স্বপ্ন পূরণ? কেননা এই শ্রেণিতে ৯জন ছাত্রীর মধ্যে ৮জনেই বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে। করোনার দেড় বছরে বিদ্যালয়ের নার্গিস নাহার বাদে যেসব ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে তারা-নুরবানু খাতুন, নাজমা খাতুন, স্বপ্না খাতুন, হেলেনা খাতুন, চম্পা খাতুন, লুৎফা খাতুন, চাঁদনী খাতুন এবং আরফিনা খাতুন। একই অবস্থা বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির চার জন ছাত্রীর মধ্যে জেসমিন ছাড়া বাকি তিন জনেরই বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। এছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণির একজন,সপ্তম শ্রেণির দু’জন, অষ্টম শ্রেণির চার জনের বাল্যবিয়ে পরিবার থেকে গোপন দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
নার্গিস নাহার জানায়, গত দেড় বছরে আমার ৮জন বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। এখন শুধু আমিই বাকি রয়েছি। স্কুল পর খোলার পর আমার বান্ধবীদের বিয়ের কথা জানতে পারি। আমি আমার বাবা-মাকে বলেছি সেই কথা। তাদেরকে এও বলেছি আমার পড়াশোনা শেষ করে একটি চাকরি করে নিজের অবস্থা তৈরি করেই বিয়ে করব। এর আগে নয়। কেননা নিজে স্বাভলম্বি না হয়ে অন্যের কাছে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। এছাড়াও নার্গিস নাহার আরও বলে, বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাওয়া এখন আমি একা। ক্লাসে আসলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কারো সাথে কোন কিছু শেয়ার করতে পারিনা। তাই মন খারাপ করেই ক্লাস করতে হচ্ছে।
এই এলাকার বাসিন্দা নাজিম আলী বলেন,মেয়ে লোকের ফুট ভাসলে বিয়ে দিতে হয়। আমাদের সরকার কি কবাইছে জানে ২১, ২২, ২৩, ১৮, ১৯, ২০বছর হলে কে নিবে মেয়েকে? কেউ নিবেন নয়। মেয়ে য়ত বড় হবে-দু, আড়াই, তিন,পাঁচ লাখ ডিমান্ড হবে। মেয়ের একটু বয়স হলেই কয় এক লাখে হবার নয়, হাত-পায়ের সোনা দেয়া নাগবে। সেজন্য প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দেয় বাবা-মা।
একই এলাকার বাসিন্দা বুলবুলি বেগম বলেন,তাড়াতাড়ি বিয়ে দেই হামরা গরিব মানুষ। মেয়ে ছইল যত বড় হইবো তত ডিমান্ড হার বাড়বো। মেয়ে যদি মেট্রিক পাশ করাই তাইলে ছেলে নেয়া লাগবো ইন্টার পাশ। সেই সামর্থ যদি হামরা করবার না পারি সে জন্য ছোটতে মেয়ের বিয়ে দেই।
একই এলাকার আহাম্মদ আলী বলেন,বাল্যবিয়ে তো এলাকায় হয় না। মেয়ে পক্ষ আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয় গোপনে। কেউ এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়ন,আবার কেউ উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়। বিয়ের কথা সাথে সাথে প্রকাশ না করে পনের দিন, একমাস পর প্রকাশ করে বাবা-মা।
বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আবদুল মজিদ চৌধুরী বলেন, ৯ম শ্রেণীতে ৩৬জন ছাত্র-ছাত্রী। এরমধ্যে ৯জন ছাত্রী আর ২৭জন ছাত্র। বর্তমানে স্কুল খোলার পর বাল্য বিয়ের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে যা খুবই দু:খজনক। তারপরেও আমরা চেষ্ঠা করছি মেয়েদের পড়ালেখা মুখি করতে।
ইউনিয়নের ৪নং ইউপি সদস্য বাহিনুর রহমান বলেন, জেলা সদর হলেও ধরলা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই ওয়ার্ড। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় প্রশাসনের লোকজনকে বেগ পেতে হয়। এছাড়াও যারা বিয়ে দেন তারা গোপনে এসব বাল্যবিয়ে দেন অন্যত্র। এজন্য আমাদের কাছে সংবাদ আসে না। বাল্যবিয়ে রোধ করতে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি ইউনিয়ন ভিত্তিক কাজী দিলে জনপ্রতিনিধির নজরদারীর কারণে বাল্যবিয়ে অনেকটাই কমে আসবে।
প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত ২২৫জন শিক্ষার্থীও মধ্যে ৬৩জন ছাত্রী। এদের মধ্যে প্রায় ৮০শতাংশ মেয়ে এবং ৭০শতাংশ ছাত্র বিদ্যালয়ে উপস্থিত হচ্ছে। বাকিদের খোঁজ খবর নিতে শিক্ষকদের নিয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদ্যালয়ে না আসার প্রকৃত কারণ তুলে ধরবেন।
একই এলাকার উত্তর হলোখানা ন¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আবদুল রাজ্জাক বলেন, তার বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণিতে-৪২ ছাত্রীর মধ্যে ২জন,৭ম শ্রেণিতে- ৪৫ছাত্রীর মধ্যে ২জন এবং ৮ম শ্রেণিতে-৩৩জন ছাত্রীর মধ্যে ৫জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছেন।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুল আলম জানান, আমরা সদরের ৫টি স্কুল পর্যবেক্ষণ করেছি এই স্কুলগুলোতে ৬৩জন মেয়ে শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় শতকরা ১৩ভাগ শিক্ষার্থী ঝড়ে পরেছে। ঝড়ে পরা কন্যা শিশুদের অধিকাংশই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এ হিসাবে জেলায় গত দেড় বছরে ঝড়ে পরা শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০হাজার। অন্যান্য স্কুল গুলোতে ঝড়ে পড়া ও বাল্যবিয়ের স্বীকার মেয়েদের প্রকৃত তথ্য নিতে উপজেলা গুলোতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে জেলার প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। তথ্য নিয়ে জেলা প্রশাসক,পুলিম সুপারসহ আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে উত্থাপন করে বিবাহ রেজিস্টার কাজীদের কিভাবে নিয়ন্ত্র করা যায় এবং এটি কিভাবে রোধ করা যায় সেভাবেই আমরা কাজ করব।
বেসরকারি সংস্থা প্লান বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী-২০১৮সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১সালের আগস্ট পর্যন্ত জেলায় মোট বিয়ে সংগঠিত হয়েছে ২২হাজার ৩৯১টি। এরমধ্যে নিবন্ধিত বিয়ে-১৯হাজার ২শ ২১টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ে-৩হাজার ১শ ৭০টি। জেলার ৯টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে ৩হাজার ১৯টি। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম সদর-৭৩০টি, রাজারহাট-৭৪টি, উলিপুর-২৬১টি, চিলমারী-১৪৬টি, রৌমারী-৮৮টি, রাজিবপুর-৫০টি, নাগেশ^রী-১১৪০টি, ফুলবাড়ি-২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে-২৩৯টি বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে। এছাড়াও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে এক হাজার ১শ ৩৬টি।