বাংলাদেশে সড়কপথে গণপরিবহনের সার্বিক চিত্র অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। এই বিশৃঙ্খলা এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার উচ্চ হারের অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু সড়ক দুর্ঘটনা নয়, সড়কপথে মানুষের চলাচলের গতিও মন্থর, ঝামেলাপূর্ণ, প্রায়ই দুর্ভোগময়। গণপরিবহনের এ খাতের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) নামের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবসায়িক আধিপত্য বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোর হাতে। মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের ব্যাপকতর ভূমিকা ও তার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করে না, কিন্তু রাষ্ট্রীয় খাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও প্রত্যাশা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিআরটিসি সেই প্রত্যাশা পূরণ থেকে সব সময়ই অনেক দূরে রয়ে গেছে।
বেসরকারি বাসমালিকদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠলেও বিআরটিসি প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছে। বিআরটিসির প্রধান তিনটি প্রকল্পÑবাস কেনা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন যে বিআরটিসিতে দুর্নীতি আছে। কিন্তু সেই দুর্নীতির লাগাম তিনি টেনে ধরতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা নেই।
২০১৯ সালে ভারত থেকে ৬০০টি দোতলা ও একতলা বাস ক্রয় করে সংস্থাটি। কিন্তু বাসগুলো আনতে না আনতেই তাতে ধরা পড়ে নানা রকমের ত্রুটি। সেগুলোর কোনোটার ছাদে ফুটো, কতকগুলোর টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে ঠিক নেই। নতুন বাসের ছাদে ফুটো ধরা পড়লে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সেগুলো কি আসলেই নতুন? নাকি পুরোনো, ব্যবহৃত এমনকি পরিত্যক্ত বাসগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে রং লাগিয়ে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের হাতে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে? সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, বিআরটিসির যেসব কর্মকর্তা ওই সব বাসের চালান গ্রহণ করেছেন, তাঁরা কি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাসগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছিলেন?
এর আগে ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দায়্যু কোম্পানি থেকে ২৫৫টি বাস কেনা হয়েছিল। এসব বাসের মেয়াদ ধরা হয় ১৫ বছর। কিন্তু ১০ বছর না যেতেই বিআরটিসি ৫টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। আরও ৩০টি বাস একইভাবে বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ঋণ নিয়ে বাসগুলো কেনা হয়েছিল। করসহ প্রতিটি বাসের দাম পড়ে ধরনভেদে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। ইডিসিএফের ঋণের শর্ত ছিল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাস কিনতে হবে।
উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাস কিনলে যে দর-কষাকষির সুযোগ থাকে, এ ক্ষেত্রে তা ছিল না। কেবল দক্ষিণ কোরিয়া নয়; চীন, ভারতসহ আরও যেসব দেশ পরিবহন খাতে ঋণ দিয়েছে, শর্ত হিসেবে তাদের বাসই কিনতে হয়েছে। ভারত ও চীন থেকে কেনা বাসও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ ঋণদাতা দেশ বেশি দামে তাদের নিম্নমানের বাসই গছিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। বড় সমস্যা হলো বাস রক্ষণাবেক্ষণ করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁদের অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাসগুলো রাস্তায় নামার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বাস ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বাসের নতুন যন্ত্রপাতি বিক্রি করে পুরোনো যন্ত্রপাতি লাগানো কিংবা আত্মসাৎ করার গুরুতর অভিযোগ আছে। বিআরটিসি দুই পদ্ধতিতে বাস পরিচালনা করে থাকেÑনিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও ভাড়াপদ্ধতিতে। যেসব সংস্থা ভাড়ায় বিআরটিসির বাস রাস্তায় নামায়, তারা এর রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে অধিক ট্রিপ দিয়ে বেশি মুনাফা পেতে উদ্গ্রীব।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, দুদক তাঁর মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁদের সহায়তা করবেন। কিন্তু ২০১৮ সালে ওই সংস্থা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বন্ধে যে ২১ দফা সুপারিশ করেছিল, গত তিন বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল মুখে ফাঁকা আওয়াজ তুললে বিআরটিসি তথা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি কখনো বন্ধ হবে না। বিআরটিসি’র বহরে নতুন আরো ১১০০টি গাড়ি যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাননীয় মন্ত্রী। এরমধ্যে ৩০০ ডাবল ডেকার (দ্বিতল বাস), ৩০০ সিঙ্গেল ডেকার বাস রয়েছে। এসব বাসের মধ্যে ২০০টি এসি এবং ১০০টি নন এসি। এ ছাড়া ৫০০টি ট্রাক যুক্ত হবে। কিছু গাড়ি ইতোমধ্যে গাজীপুরে চলেও এসেছে। নতুন যোগ হতে যাওয়া এই গাড়িগুলো যাতে টেকসই হয়, জনগনের স্বস্তির বাহন হয় সেজন্য কঠোর নজরদারি করতে হবে।