স্বাস্থ্যের খরচ বৃদ্ধি সারা বিশ্বে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মূল কারণ হলো নতুন নতুন সংক্রমণ রোগের আবির্ভাব, বয়স্ক লোকের হার বৃদ্ধি, নতুন মেডিকেল টেকনোলজির উদ্ভাবন, এবং আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি। কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত মূলত সাধারণ রাজস্বনির্ভর সরকারি অর্থায়ন (২৩ শতাংশ) ও ব্যক্তিগত অর্থায়নের (৬৭ শতাংশ) ওপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্যবিমা মূলত কয়েকটি জীবনবিমা কোম্পানির জীবনবিমার সঙ্গে গোষ্ঠীগত স্বাস্থ্যবিমা হিসেবে চালু আছে। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বাস্থ্যবিমার দায়িত্ব মূলত জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির হলেও হাতে গোনা দু-চারটা জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ছাড়া এ ক্ষেত্রে কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নে স্বাস্থ্যবিমার ভূমিকা ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। আর সমগ্র বিমা খাতের অবদান মোট জাতীয় আয়ের ১ শতাংশেরও কম।
এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার খবরটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী ২৭০ টাকা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বছরে চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সুবিধা পাবেন, যার মধ্যে থাকবে চিকিৎসকের ফি, ওষুধের দাম ও রোগনির্ণয় পরীক্ষার ফি। তবে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হলে শিক্ষার্থীকে পরিশোধ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক থাকাকালে সৈয়দ আবদুল হামিদ ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্যবিমা চালু করেন। সে সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য বিভাগেও চিঠি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিমা করার অনুরোধ জানান এবং অর্থনীতি, ইতিহাস, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, সংস্কৃত, নৃবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগও একই কর্মসূচি নেয়। সে সময় শিক্ষার্থীদের প্রিমিয়াম ছিল ৪০০ টাকা এবং তাঁরা বছরে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকার চিকিৎসাসেবা পেতেন। এই প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ২ জুন ডিনস কমিটির বৈঠকে সব শিক্ষার্থীর বিমা চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা আগে থেকে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় ছিলেন।
আমাদের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের ক ধারায় অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ নিশ্চিত করার কথা আছে। কিন্তু দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ এখনো এসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এ সতর্কবার্তাও জানাতে চাই, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে আমাদের দেশে অনেক ভালো উদ্যোগই ভেস্তে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রেও যাতে সে রকম কিছু না হয়, সে জন্য কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্সে নামে যে বিমা কোম্পানি এ দায়িত্ব পেয়েছে, পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে তারা যেন যথাযথ সেবা নিশ্চিত করতে পারে, সেদিকে তাদের খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে অনলাইনে কাগজপত্র জমাসহ তাঁদের দাবি পেশ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কিছু হাসপাতালের সঙ্গে তাঁরা চুক্তিবদ্ধ হতে পারেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিমার কাগজপত্র দেখিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা যাতে বিড়ম্বনা ও সময়ক্ষেপণের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার কথা বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে না পারলে তা সুদূরপরাহতই থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরকেও একটা শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রথমে এ-সংক্রান্ত একটি যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে। আর এ আইনের আওতায় একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন বেনিফিট প্যাকেজ প্রণয়ন, প্রিমিয়াম নির্ধারণ, হাসপাতাল ইমপ্যানেলমেন্ট, ক্লেইম সেটেলমেন্টসহ স্বাস্থ্যবিমার যাবতীয় কাজ সম্পাদন করবে।