পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বাংলাদেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এ জন্যই দেশ মাদকে সয়লাব। মাদক ব্যবসার সঙ্গে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। ধারণা করা যাচ্ছে, এর সংখ্যা অনেক। এদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করা যাবে না। মাদকের কারণে সমাজে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তরুণদের ভবিষ্যৎ। খুন থেকে শুরু করে নানারকম অপরাধপ্রবণতা তৈরি হচ্ছে সমাজে। মাদকের কারণে ছেলে মা-বাবাকে খুন করছে। এর চেয়ে সামাজিক অবক্ষয় আর কী হতে পারে?
মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ও ভয়ংকর ছোবল দেশের সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী, তারা অন্ধকারে পথ হারিয়েছে। জাঁতি বিধ্বংসী এ মাদক থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০নং আইন) প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি প্রণয়ন করা হয়। এরপরেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। উন্নতি হয়নি দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েও।
কিছুদিন আগেও এলএসডিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। উলেস্নখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে উদ্বেগজনক সব তথ্য উঠে আসে। ভয়াবহ ক্ষতিকর মাদক এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথালমাইড) সেবন তাকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে বলেও ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ- যা রাই এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি। ১৯৩৮ সালে হফম্যান এই মাদক আবিষ্কারের পর এটি বিজ্ঞানী এবং ফিজিশিয়ানদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর, হফম্যান আবার এলএসডি-২৫ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করালেন। এরপরই তিনি চলে যান স্বপ্নের জগতে। এলএসডি সেবন ও ব্যবসায় জড়িত ১৫ দল রাজধানীতে সক্রিয়। লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথালামাইড মাদক মহলে এলএসডি নামে পরিচিত। এটা জিহ্বার নিচে নিয়ে কিংবা ইনজেকশনের মাধ্যমে সেবন করা হয়। এলএসডি এমন এক নতুন ধরনের মাদক- যা সেবন করলে, সেবনকারী নিজেকে মহাশক্তিধর ভাবে এবং যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। মূলত এই ভয়ংকর মাদক সেবন করলে মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তি হারিয়ে ফেলে। এখন আবার নতুন ধরনের মাদক বের হয়েছে, যার নাম আইস। আইসসহ প্রায়ই ধরা পড়ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। ধরা পড়ছে বড় বড় মাদকের চালান। প্রশ্ন উঠতে পারে দেশব্যাপী মাদকের সরবরাহ নিশ্চিত করছে কারা? কারা দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর কি কোনো পরিত্রাণ নেই।
এর আগে ৪২ জন কোটিপতি মাদক ব্যবসায়ীর সন্ধান পেয়েছিল সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এদের মধ্যে দুজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। বাকি ৪০ জনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারণা এই কয়জনকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে, রাজধানীতে অনেকটাই মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, আমরা প্রতি ৩ মাস পরপর তালিকা তৈরি করি। এরপর ওই তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই তালিকা ধরেও সমন্বয় করে কাজ করা হয়।
উল্লেখ্য, রাজধানীতে মাদকের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। এর আগে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে সরকারে একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। ওই তালিকা অনুযায়ী অভিযান শুরু করা হয়। এতে অনেকেই গা ঢাকা দেন। ধারণা করা হচ্ছে অভিযানের জোরদারের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
বিভিন্ন ধরনের মাদকের মধ্যে- হেরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, তামাক, বিড়ি, সিগারেট, স্পিড, ঘুমের বড়ি, তোসকা ইত্যাদি। এসব মাদকদ্রব্য আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশের যুবসমাজ বিভিন্ন কারণে মাদকসেবন করে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে- যা খুবই পরিতাপের বিষয়।
বাংলাদেশে ইয়াবা আর ফেনসিডিলের বাজার তৈরি হওয়ায় মিয়ানমার এবং ভারত সীমান্তে অসংখ্য ইয়াবা আর ফেনসিডিলের কারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্য মিয়ানমার মরণ নেশা ইয়াবা এবং ভারত থেকে ফেনসিডিল উৎপাদন করে তা নির্বিঘেœ সরবরাহ করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, এসব দেশে মাদক তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্যই। বাংলাদেশঘেঁষা সীমান্তে মিয়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সে সব কারখানা কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। অবাক করা ব্যাপার, মিয়ানমারের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা আশক্ত নয়। কোনো কোনো এলাকায় ইয়াবা কী তা সেখানকার অধিবাসীরা জানেনই না। মূলত বাংলাদেশিদের জন্যই সেখানে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের মৌন সম্মতিও আছে। মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না এটাই এখন বড় প্রশ্ন? মাদক কারবারিরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে, ধরাও পড়ছে মাঝেমধ্যে। যারা ধরা পড়ে তারা কেবল চুনোপুঁটি। আবার ওদের গডফাদারদের বদান্যতায় ওরা সহসাই ছাড়া পেয়ে যায়। দেশের প্রতিটি সীমান্তেই এমন হচ্ছে। ভারতের সীমান্তেও অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বাংলাদেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এ জন্যই দেশ মাদকে সয়লাব। মাদক ব্যবসার সঙ্গে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। ধারণা করা যাচ্ছে, এর সংখ্যা অনেক। এদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করা যাবে না। মাদকের কারণে সমাজে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তরুণদের ভবিষ্যৎ। খুন থেকে শুরু করে নানারকম অপরাধপ্রবণতা তৈরি হচ্ছে সমাজে। মাদকের কারণে ছেলে মা-বাবাকে খুন করছে। এর চেয়ে সামাজিক অবক্ষয় আর কী হতে পারে?
মাদকের সহজলভ্যতা, অসৎসঙ্গ, মা-বাবার বেপরোয়া আচরণবিধি, ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হওয়া, স্মার্ট হওয়ার জন্য, পারিবারিক কলহসহ ইত্যাদি কারণে হতাশ যুবকরা মাদক সেবন করে থাকে। নিওরো কেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাদক সেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্তিষ্কের কিছুকিছু জায়গায় অতিদ্রম্নত এবং বেশি পরিমাণে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়- যা কোনো ব্যক্তিকে মাদকের আনন্দ দেয় এবং পরবর্তী সময়ে ব্যবহারে উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদকে আসক্ত তাদের বেলায় আবার উল্টোটা দেখা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন মাদক নেওয়ার ফলে যে ডোপামিন একজন মানুষকে নেশার আনন্দ দিত তা আস্তে আস্তে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রতিটি পিতামাতার উচিত তাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনার্থে মাদক থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তাদের সঠিকভাবে দেখাশোনা করা, তাদের প্রতি অধিক যতœবান হওয়া। চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিরতা এর জন্য মাদকের বিপজ্জনক বিস্তারই দায়ী। এমনকি বাসের চালকরাও মাদক সেবনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। ইদানীং পুলিশের বিরুদ্ধেও মাদক বেসনের অভিযোগ রয়েছে। এখনো যদি সরকারের টনক না নড়ে তবে, এই মাদককে কেন্দ্র করে যুবসমাজ যেমন ধ্বংস হয়ে যাবে, একইভাবে দেশের ভবিষ্যৎও হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ আজকের তরুণরাই আগামী দিনের কান্ডারি। তারাই একদিন দেশের হাল ধরবে। সুতরাং সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।