সারা পৃথিবীতে ই-কমার্স রমরমা। বাংলাদেশেও ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতির সংগে সংগে এই ব্যবসা জমে উঠেছে। কোভিড-১৯-এর আর্শীবাদে ই-ব্যবসায়ীরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু তাতেও তাদের সাধ মেটে না। গ্রাহকের পকেট খালি করে তাদের পকেট ভারী করাই লক্ষ্য। জাঁকজমকপূর্ণ ও আকষর্ণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে বা প্রচার চালিয়ে গ্রাহকদের বোকা বানিয়ে আকৃষ্ট করে ‘ই’ অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক ফাঁদে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট-পাট করে আসল বা সত্যিকারের ই-ব্যবসায়কে কলংকিত করেছে এবং নিঃস্ব করেছে লক্ষ লক্ষ গ্রাহককে যারা অধিকাংশই চাকুরীজিবী বা মধ্য আয়ের লোক এবং নি¤œ মধ্য বয়সী। জীবনের বা কর্ম জীবনের উঠতি সময়েই তারা ধরা খেল। কেননা, তাদের পক্ষে মোটা অংকের নগদ টাকা দিয়ে ইলেক্ট্রনিক আইটেম ক্রয় করা কঠিন। দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে এদের অনেকেই একটি মোটর সাইকেল কিনার সামর্থ রাখে না। যখন দেখা যায় ৪০% /৫০% ছাড়ে একটি মোটর সাইকেল পাওয়া যায় অন লাইনে তখন আর লোভ সামলাতে পারে না। বিশ্বাস করে অগ্রিম দেয়। এরপর আর মোটর সাইকেলের টিকিটিও দেখতে পায় না। এমনই করেছে ই-ভ্যালির মত তিন ডজনের বেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এই দলে রয়েছে কিউকম, এসপিসি, ডেসটিনি, যুবক, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা,আলিফ ওয়ার্ন্ড, দারাজ, ব্রাইট হ্যাস, আকাশ নীল, গেজেট মার্ট, সেরেস্ত ডটকম, আস্থার প্রতীক, টিকটিকি, শপ আপ, নিরাপদ ডটকম, ইউনিপে টু ইউ, আলেশা মার্ট, সহজ, আদিয়ান মার্ট, দালাল প্লাস, সিরাজগঞ্জ শপ ডটকম, বাইও টেক, সহজ লাইফ, প্রিয় শপ, বুমবুম, নিড্স্ ডটকম, আ্যামস বিডি,আলাদিনের প্রদীপ, বিক্রয় শপ ইত্যাদি। এর বাইরেও এধরণের ভুয়া ও ধোঁকাবাজ প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে। অন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে ই-ব্যবসা করছে তাদের মধ্যে রয়েছে আজকের ডাল, উবার, পাঠাও, ডেইলি শপিং, অথবা, পিকাবো, রকমারী, বই বাজার, বিডিশপ, ঘরবাজার, বিক্রয়, ফুড পান্ডা ইত্যাদিসহ ১০০-এরও বেশী প্রতিষ্ঠান। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা (স্ত্রী-স্বামী) আটকের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও অর্থ পাচার নিয়ে অনুসন্ধান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করছে। সম্প্রতি আরও ২৩টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্তাব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ফিন্যাসিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বি এফ আই ইউ)। গ্রাহকদের প্রতারিত করার অভিযোগ মোট ৩৩টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কালো তালিকাভুক্ত করেছে এবং আইনি প্রক্রিয়া চলছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও এখন সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে।
সশরীরে বা বাজারে গিয়ে কেনা-কাটার পরিবর্তে ইন্টারনেট, অনলাইন, ওয়েব সাইট বা অন্য কোন কম্পিউটার বা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় করাকে ই-কমার্স (ঊষবপঃৎড়হরপ ঈড়সসবৎপব) বা ই-বানিজ্য বা ই-ব্যবসায় বলা হয়। একে ইন্টারনেট বা অনলাইনে পরিচালিত ব্যবসা বা ব্যবসায়িক লেন-দেনও বলা যায়। বিশ্বে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে আমাজন, আলীবাবা, অ্যালফাবেট (অষঢ়যধনবঃ), ফেসবুক, উবার, জেডি ডটকম (ঔউ.পড়স), বাইট ড্যান্স (ইুঃব উধহপব), পে পল (চধু চধষষ), এ্যাডোব (অফড়নব), ই-বে (ঊ-ইধু) সুপরিচিত। নুন্যতম ১০০টি আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সুনামের সাথে ব্যবসা করছে। এর কয়েকটি বাংলাদেশেও কাজ করছে যেমন আমাজন, আলীবাবা, উবার, দরাজ ইত্যাদি। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়েবসাইট আমাজন কমবেশী ৪০০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করছে বছরে। কিন্তু তাদের ইতিহাসে আমাদের দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মত গ্রাহককে নিঃস্ব করার ঘটনা নেই। অবশ্য কখনো কখনো দু’একটি অনিয়ম বা ভুল ধরা পড়েছে। তেমনি অন্যান্য কোম্পানীগুলোও। ২০০০ সাল থেকেই বিশ্বে ব্যপকভাবে ই-কমার্স চালু হয়েছে যদিও ৮০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এটি শুরু হয়েছিল। মূলতঃ বিগত শতাব্দীতে টেলিফোন আবিষ্কার এবং পরে ক্রেডিট কার্ড ও এটিএম-এ লেনদেন গ্রহণ করার পর আশির দশকে এই ব্যবসার প্রসার শুরু হয়। ইন্টারনেট ও ফেসবুকের প্রসারে এই বানিজ্য জমে উঠে। বাংলাদেশেও সীমিত আকারে ২০০৯ সালে এবং ১০১৩ সালে ব্যাংকগুলো অনলাইন পেমেন্ট শুরু করার মাধ্যমে ই-কমার্স ব্যবসায় শুরু হয়।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ই-ভ্যালি ডটকম লিমিটেডের এমডি ও প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল ও তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রেপ্তার হওয়ার পর মিডিয়া সরগম হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি, প্রতারণা ও অর্থ আতœসাতের বিষয়ে সংবাদ ও প্রতিবেদন আসতে থাকে। সরকারও নড়েচড়ে বসে। একসংগে চার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা বৈঠকে বসেন। ই-কমার্স প্ল্যাটফরম নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন করার সিন্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী ছয় মাসের মধ্যে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিলে আইনটি সংসদে পাশ হবে। এর আগে গত জুলাই মাসে ই-কমার্স নীতিমালা প্রণীত হয়, ২০১৮ সালে তা সংশোধন করেছিল সরকার যা কার্যকর হয়নি। ২০১৯ সালের ২৭শে নভেম্বর প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন “বেসরকারী খাত উন্নয়ন নীতি সমন্বয় কমিটির” সভায় সিন্ধান্ত হয় যে ই-কমার্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও এটু আই (অংঢ়রৎব ঃড় ওহহড়াধঃরড়হ) যৌথভাবে “এসক্রো সেবা” চালু করবে যাতে পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা পাবে ই-কমার্সের প্রতিষ্ঠান। তার আগে থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে। এটিও বাস্তবায়িত হয়নি। এর বাস্তবায়নে ই-কমার্স এসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব বা ঊ-ঈঅই) বানিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়। এসক্রো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা হলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো এতো দূর এগুতে পারত না। ইতোমধ্যে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে অর্থ আতœস্যাৎ ও প্রতারণার ৭ হাজার ১৩৮টি অভিযোগ হয়েছিল। এর মধ্যে অনেকগুলি নিস্পত্তি করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন পরিদপ্তর। ই-ভ্যালি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ২০৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে এবং গ্রাহকের ৩১১ কোটি টাকা আটক পড়েছে। কোন কোন রিপোর্টে দেনা এরও বেশী রয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ই-ভ্যালির সম্পদ রয়েছে মাত্র ৫০ লক্ষ টাকার। ই-ভ্যালির মত পণ্য সরবরাহ না করে গ্রাহকদের ২৫০ কোটি টাকা আটকে রাখার অভিযোগে কিউকমের সিইও রিপন মিয়া এসপিসি ওয়াল্ড এক্সপ্রেসের এমডি ও সিইও আল-আমীন ও পরিচালক শারমিন আক্তার গ্রাহকের ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সি আইডি কর্তৃক। সিরাজগঞ্জ শপ ডটকমের মালিক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয় মোবাইল ফোন ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ‘নগদ’-এর সাড়ে ৪৭ কোটি টাকা আতœসাৎ করার অভিযোগে। গ্রাহকের ৯ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনসহ সাতজনের বিরূদ্ধে মামলা হয়। গত ৩১শে অক্টোবর ২০২১ গ্রাহকদের অর্থ আতœস্যাতের অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আদিয়ান মার্টের সিইওসহ চার কর্মকর্তাকে চুয়াডাঙ্গায় গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারীভাবে কোন হিসাব না থাকলেও পুলিশ, র্যাব, গ্রাহক ও মালিকদের দাবী বা দেয় তথ্য অনুযায়ী ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডের কাছে গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ৩,১২১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে যুবকের (যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি) অবৈধ ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন প্রতারণার চিত্র উঠে আসে। ২০১০ ও ২০১১ সালে যুবকের বিরূদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং এর সম্পদের বিষয়ে দুইটি কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী যুবকের ৩,০৩,৭৩৯ জন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের দাবীর পরিমান ২,৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। ২০১২ সালে ৪৫ লাখ গ্রাহকের সাথে প্রতারণার অভিযোগ উঠে ডেসটিনি গ্রুপের বিরূদ্ধে। ২০১৩ সালে আদালতের নির্দেশে ডেসটিনির সমস্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষন ও তদারকির দ্বায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশকে। ডেসটিনি ও যুবকের প্রচুর সম্পদ রয়েছে যা দিয়ে গ্রাহকের পাওনা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু গত ৮ বছরে কোন গ্রাহক টাকা ফেরত পায়নি। ডেসটিনি বহুস্তর বিপণন পদ্ধতির (এম এল এস-গঁষঃর খধুবৎ গধৎশবঃরহম) ব্যবসার মাধ্যমে ৪,১১৮ কোটি টাকা তুলে নেয় গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের কাছ থেকে। মজার ব্যপার হল, এইসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারে চিত্র নায়িকাসহ নামী-দামী শিল্পী ও ক্রীড়াজগতের সিলেব্রিটিদের মোটা অংকের সম্মানীতে ব্যবহার করা হয়। এদের উচ্চ পদে উচ্চ পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাগণ নিয়োজিত থাকেন। ডেসটিনির একজন এম ডি ছিলেন একজন প্রাক্তন সেনা প্রধান ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। এভাবে ডেসটিনি, যুবক ও ই-ভ্যালির মত ই-বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী ইভেন্টে প্রধান স্পনচর হিসেবে অংশ গ্রহণ করত যে সব অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে এসব অনুষ্ঠানে অনুদান দিয়ে মন্ত্রী ও সেলিব্রিটিদের উপস্থিতির মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করত। গেপ্তারের পর “এত টাকা কোথায় গেল” এই প্রশ্নের উত্তরে ই-ভ্যালির প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে প্রচার-প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনে প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। এভাবেই তারা ফাঁদ পেতে গ্রাহক-জনতাকে বোকা বানিয়ে তাদের অর্থের বিনিময়ে নিজেরা হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের নিঃস্ব করেছে।
গত কয়েক বছরে যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু টাকা ফেরৎ দেয়ার কোন ব্যবস্থা হয়নি। আইনি প্রক্রিয়ায় কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তো কিছু গ্রাহক টাকা ফেরৎ পাবে তাও সময়ের ব্যপার। আর পেলেও ১০০% ফেরৎ পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোন গ্রাহক টাকা ফেরৎ পায়নি। ইতোমধ্যে ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে সরকার কতিপয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। গত ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে বানিজ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীসহ আরো উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নিয়ে এ ব্যপারে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বৈঠকে বসেন। বানিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বসা এই বৈঠকে ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং কমিটির কার্যপরিধি ঠিক করে দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ই-কমার্স আইন প্রনয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে জুলাই ২০২১-এর প্রথম দিকে বানিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা জারী করেছিল যার ফলে ই-বানিজ্যের প্রতারণা সীমিত হয়ে আসে। কিন্তু এর আগেই অঘটন যা ঘটার তা ঘটে গিয়েছে। আগামী মার্চ-এপ্রিলের দিকে নূতন আইন সংসদে পাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ধারাবাহিকভাবে এর প্রক্রিয়া চলবে। ই-কমার্স প্ল্যাটফরম নিয়ন্ত্রণে নূতন আইন কঠোর, শক্তিশালী ও সময়োপযোগী হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বর্তমানে এ সম্পর্কিত যে আইন বা ধারা প্রচলিত আছে (দন্ডবিধির ৪২১ ধারা) তাতে ই-কমার্সের ফাঁদে ফেলা কোম্পানীগুলোর হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায় না, ছয় মাসের বেশী জেলও দেয়া যায়না। জেল থেকে বের হয়ে আবার তারা দাপিয়ে বেড়াবে। নূতন আইন তাই অধিকতর শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। গত ১৮ই অক্টোবর ২০২১ তারিখে একটি একক হাই কোর্ট বেঞ্চ ই-ভ্যালী লিমিটেডের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য চার সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে এই বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। আশা করা যাচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের ই-বানিজ্য নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং ভূক্তভোগী গ্রাহকরা আশান্বিত হবে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ -এর কারণে যখন জীবন যাত্রা অচল হয়ে পড়েছিল, মানুষ বাইরে-বাজারে যেতে ভয় পেত তখনই সহজে ঘরে বসে পণ্য পাওয়ার মাধ্যম ছিল ই-ব্যবসা বা অনলাইন ক্রয়-বিক্রয়। কিন্তু ডজন খানেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের হতাশ ও নিঃস্ব করে। চটকদার ও চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে অস্বাভাবিক ডিসকাউন্টের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পিলপিল করে লোভী গ্রাহকরা অগ্রিম দেয়া শুরু করে। প্রথম প্রথম এই বিশাল ডিসকাউন্টে দামী ইলেক্ট্রনিক দ্রব্য, মোটর সাইকেল ইত্যাদি পাওয়ার পর পুনরায় লোভের বসে একইসংগে কয়েকটি কোম্পানীতে অগ্রিম দেয় নামে-বেনামে। আর এখানেই ফেঁসে যায় অতিলোভী গ্রাহক। তারা বুঝতে পারেনি যে প্রথমদিকে কিছু পণ্য সরবরাহ করা ছিল ঐসব ই-বানিজ্য প্রতিষ্ঠানের চালাকী। এই জালিয়াতির কারণে ই-ব্যবসার প্রতি গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ও ব্যবস্থা গ্রহণে আর নিয়ন্ত্রিত ই-বানিজ্যের মাধ্যমে এটি প্রাণ ফিরে পাবে। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ই-ক্যাবের মতে বাংলাদেশে ৭০০ ই-কমার্স সাইট এবং ফেসবুকে ৮,০০০ পেজ রয়েছে। অন্যান্য রিপোর্টে এর সংখ্যা অনেক বেশী। পর্যবেক্ষকদের মতে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ই-কমার্স সেক্টরের আয়তন প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার হবে। গ্রাহকদের সুবিধার্থে অর্থাৎ যেন সহজে অসংখ্য ওয়েব সাইট থেকে নিজের প্রয়োজনীয় পণ্য নির্বাচন করতে পারে সেজন্য দেশের প্রথম অনলাইন ভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল অষষড়হষরহব ংযড়ঢ়.নফ পণ্যের ধরণ অনুযায়ী তালিকা সাজিয়েছে। তবে অনলাইন ব্যবহার প্রসারে কিছু সমস্যাও রয়েছে। আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের জ্ঞানের অভাব এবং যোগাযোগ ও ডেলিভারির সীমিত ব্যবস্থা অন্যতম। এছাড়া, ই-বানিজ্য কোম্পানীগুলো সঠিক সময় সর্বাধিক মানের পণ্য সরবরাহ করে না। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহক দু’পক্ষেরই বেশী লাভ করার প্রবণতা রয়েছে। তাতেই গন্ডগোলটা বাধে। আমাদের দেশের গ্রাহকরা চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন ও অস্বাভাবিক মূল্যছাড় দেখে লোভ সামলাতে পারে না। তাই বাস্তবতার বিবেচনা না করে এসব জালিয়াত প্রতিষ্ঠানের ফাঁদে পা দেয়। গ্রাহকদেরও সতর্ক থাকতে হবে। ই-ভ্যালির মত প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নিয়ন্ত্রিত ই-বানিজ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্রাহক সেবা নিশ্চিত হবে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী নিজে অসৎ ও গ্রাহক ঠকানো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। সেটিই বাস্তবায়িত হোক। গ্রাহকরা যেন আর ফাঁদে না পড়ে।
অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক