সাতক্ষীরায় গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় এক মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের দাবি তাকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করা হলে তিনি আত্মহত্যা করেন। অপর দিকে পরিবারের দাবি তাকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত বাবুল সরদার (৫৬) সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জুড়ন সরদারের ছেলে। তার লাশ নিতে অস্বীকার করে স্বজনরা ন্যায় বিচারের দাবি জানান।
তবে পুলিশের দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধা জুড়ন সরদারের ছেলে বাবুল সরদার (৫৬) গোয়েন্দা পুলিশের লকআপের মধ্যে আত্মহত্যা করেছে। তার বিরুদ্ধে আরও পাঁচটি মাদক মামলা রয়েছে।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ইয়াসিন আলম চৌধুরী জানান, বাবুল সরদার নামের ওই ব্যক্তিকে শনিবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে তার গ্রামের বাড়ি দেবহাটা উপজেলার বসন্তপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।এসময় তার কাছ থেকে ৫০ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন- গ্রেপ্তার হওয়া বাবুল সরদারকে গোয়েন্দা পুলিশের লকআপে রেখে দেওয়া হয়। রোববার (১২ ডিসেম্বর) তাকে আদালতে নিয়ে যাবার কথা ছিল। শনিবার দিবাগত রাতের কোন একসময় সে গলায় নিজের কোমরে ব্যবহৃত ঘুনশি ( সুতো) লকআপের গেটের গ্রীলের সাথে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। পরে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়।
বাবুল সরদারের মেয়ে সুলতানা মুন্নি জানান, শনিবার সকাল ১০টার দিকে বোরকা পরা এক নারী আকস্মিকভাবে তাদের বাড়িতে ঢুকে তার বাবার ঘরে গিয়ে ফেন্সিডিল রেখে নিকটে থাকা গোয়েন্দা পুলিশকে ইশারা করে। সঙ্গে সঙ্গে তার বাবাকে ওই ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এসময় ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ৩৬ হাজার টাকাও নিয়ে যায় তারা। মুন্নি বলেন, আমার বাবা কোমরে কখনও ঘুনশি (সুতো) ব্যবহার করতেন না। তাহলে তিনি কিভাবে লকআপের মধ্যে আত্মহত্যা করলেন প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, গেটের গ্রীলের সাথে নিজেকে সুতালিতে ঝুলিয়ে কি কখনও আত্মহত্যা করা সম্ভব? পুলিশ তাকে হত্যা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।
এদিকে বাবুল সরদারের ছেলে আলমগীর হোসেন জানান, তার বাবাকে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে ৪৫ বোতল ফেন্সিডিলসহ আটক করা হয়। এ সময় বাড়িতে থাকা ৩৬ হাজার টাকাও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা নিয়ে যায়। তিনি বলেন- পুলিশ আমার বাবাকে মারধর করেছে এবং একপর্যায়ে তিনি মারা গেছেন। এখন পুলিশ নাটক করে বলছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আলমগীর হোসেন আরও বলেন পুলিশ আমাদের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছে ‘আপনাদের লোক আত্মহত্যা করেছে। লাশ নিয়ে যান’। আমরা বলেছি আমাদের স্বজনকে জীবিত অবস্থায় ফেরত দিতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তি নিজের কোমরে থাকা রশি পেঁচিয়ে লকআপের গেটের গ্রীলে ঝুলে রাত তিনটার দিকে আত্মহত্যা করেছে। পরে ম্যাজিস্ট্রেট আকতার হোসেন ও মেডিকেল অফিসার ডা. জয়ন্ত কুমারের উপস্থিতিতে লাশ নামিয়ে ময়নাতদন্ত করার জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সুপার আরও জানান এই ষ্পর্শকাতর ঘটনায় পুলিশের এএসআই শেখ সোহেল ও কনস্টেবল শরিফুলসহ দুই সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা প্রেরিত “সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশ কর্তৃক ৫০ বোতল ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তারকৃত আসামীর হাজতখানায় আত্মহত্যা প্রসঙ্গে” শীর্ষক এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে “সাতক্ষীরা ডিবি পুলিশের এসআই(নিঃ)/মোঃ মনিরুল ইসলাম সংঙ্গীয় ফোর্সসহ গত ১১/১২/২০২১খ্রিঃ তারিখ দুপুর ১২.১০ ঘটিকার সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাতক্ষীরা দেবহাটা থানাধীন সীমান্তবর্তী এলাকা বসন্তপুর গ্রামে আসামি বাবলু সরদার (৫২), পিতা-মৃত জুড়োন সরদার, সাং-বসন্তপুর, থানা-দেবহাটা, জেলা-সাতক্ষীরাকে (ভারতীয় আমদানি নিষিদ্ধ) ৫০ বোতল ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামীকে উদ্ধারকৃত আলামতসহ ডিবি হেফাজতে রাখা হয়। এ ঘটনায় দেবহাটা থানায় মামলা নং-০৬, তারিখ ১১/১২/২০২১খ্রিঃ তারিখ ধারা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫বি (২) রুজু হয়। ওই মামলার আসামি বাবুল সরদার ডিবি হেফাজতে হাজতখানায় থাকা অবস্থায় রাত ৩ ঘটিকা হতে ৫ ঘটিকার মধ্যে যে কোন সময় তার পরিহিত লুঙ্গির কাইতেন (নাইলনের মোটা সুতা/কাইতেন) দিয়ে হাজতখানার লোহার দরজার রডের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আসামীর বিরুদ্ধে মাদক আইনে আরো ৪ টি মামলা বিচারাধীন আছে।
এ ঘটনায় জনাব মোঃ আক্তার হোসেন, বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন, ডাঃ জয়ন্ত সরকার, মেডিকেল অফিসার, সিভিল সার্জন অফিস, সাতক্ষীরা, মৃত ব্যক্তির ছেলে, স্ত্রীসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন এবং জেলা পুলিশের উদ্ধর্তন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়েছে এবং ময়না তদন্তের জন্য লাশ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। এ বিষয়ে অন্যান্য আইনানুগ কার্যক্রম অব্যহত আছে। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলা এবং গাফেলতির কারণে কর্তব্যরত এএসআই(নিঃ)/মোঃ সোহেল শেখ এবং কং/৪৪৮ শরিফুল ইসলামকে সাময়িক বরখস্ত করা হয়েছে।”