বাংলাদেশে নদ-নদীর পাশাপাশি আছে অসংখ্য হাওড়। হাকালুকি হাওড় দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাওড়। এই হাওরের অংশ গোটাউরা হাওরখাল জলমহাল। এটি নানা প্রজাতির মাছে বেশ সমৃদ্ধ। তাই এই জলমহাল বা বিলটির ইজারা নেওয়ার জন্য মৎস্যজীবীরা মুখিয়ে থাকেন। অভিযোগ আছে, প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও তা থেকে লাভবান হন। তাই বিলের ইজারা নিয়ে অতীতে অনেক মামলাও হয়েছে।
জানা যায়, এখনো দুটি মামলা চলমান রয়েছে। একটি মামলায় ইজারাসংক্রান্ত সব কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করা হয়েছে। তার পরও সরকার নির্ধারিত মূল্যের প্রায় অর্ধেক মূল্যে মাত্র ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় একটি সমবায় সমিতিকে গোপনে বিলটি ইজারা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এর সরকারি ইজারা মূল্য ৮২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বলে জানিয়েছেন অন্যান্য মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লোকজন। তাঁদের অভিযোগ, জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল এ বছর বিলটি ইজারা দেওয়া হবে না। অথচ এখন তাঁরা দেখছেন, বিলটি ইজারা দেওয়া হয়ে গেছে। তাঁরা জেলা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
হাকালুকি হাওর শুধু বাংলাদেশের নয়, এশিয়ার বৃহত্তম স্বাদু পানির জলাশয়। ভারতের মেঘালয় ও ত্রিপুরার পার্বত্যাঞ্চলের পাদদেশে থাকা হাওরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। কিন্তু পর্যটন সুবিধা না থাকায় সেভাবে তার বিকাশ হচ্ছে না। তার পরও রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলজ জঙ্গলসহ হাওরের নানা অংশে প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা হয়। মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় এই হাওরটির অবস্থান। এর মোট ভূমির পরিমাণ ২০ হাজার ৪০০ হেক্টর। এই হাওরে মোট ২৩৮টি বিল রয়েছে। ১০টি নদীর সঙ্গে হাওরটির সংযোগ রয়েছে। এর রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। আছে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, স্থানীয় ও পরিযায়ী মিলে ৪১৭ প্রজাতির পাখি এবং ১৪১ প্রজাতির অন্যান্য প্রাণী। মাছের দিক থেকেও হাওরটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে ১০৭ প্রজাতির দেশীয় মাছ। মৎস্যবিজ্ঞানীরা এজন্য হাওরটিকে ‘দ্য মাদার অব ফিশারি’ বা মাছের প্রাকৃতিক জননী বলে উল্লেখ করেন। বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশব্যবস্থা রক্ষা করার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে ‘রামসর’ কনভেনশন। বিভিন্ন দেশের জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ জলাভূমিগুলোকে আন্তর্জাতিক রামসর তালিকায় সংযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের এমন দুটি এলাকা হলো সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের তৃতীয় জলাভূমি হিসেবে হাকালুকি হাওরকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই অবস্থায় হাওরের অংশ হিসেবে থাকা বিলগুলো এভাবে ইজারা দিয়ে হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার অর্থ কি?
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, রাষ্ট্রের জন্য ৪১ লাখ টাকা কোনো টাকাই নয়। এটি আন্তর্জাতিক রামসর তালিকায় যুক্ত হলে এবং মোটামুটি পর্যটন সুবিধা গড়ে তোলা গেলে এখান থেকে অনেক বেশি আয়ও হবে। তার চেয়েও বড় হলো এর জীববৈচিত্র্য, যাকে অর্থ দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। প্রাণী, উদ্ভিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানীদের নিয়ে হাকালুকি সংরক্ষণে সরকার উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ করবে এটাই প্রত্যাশা।