দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোর নির্বাচন ছ’ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপ যথাক্রমে অনুষ্ঠিত হবে ৫ জানুয়ারি ২০২২ ও ৩১ জানুয়ারি ২০২২। কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে সারাদেশে সংঘর্ষ-সহিংসতা ঘটছে লাগাম হীনভাবে। এর সাথে রয়েছে প্রতিপক্ষের প্রতি হুমকি-ধামকি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা খুব বেশি বেপরোয়া আচরণ করছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের সায়েস্তা করতে তারা প্রার্থীকে ও সমর্থকদের শারীরিকভাবে হেনস্থা, বাড়িতে ও নির্বাচনী অফিসে হামলা, প্রচারণার সময় বাধাদান করে পরিবেশ সহিংস করে তুলছেন। এর সাথে কতিপয় সাংসদের দলীয় প্রার্থীর প্রচারণায় অংশ নিয়ে অসংলগ্ন বক্তব্যের কারণে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। যদিও স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন) আচরণ বিধিমালা-২০১৬-এ (২ এর ১৪) অনুযায়ী ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্য প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না।
নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের দু’জন সাংসদ তাদের এলাকায় নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়ে বক্তব্য দেবার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলেও নির্বাচন কমিশন তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অবশ্য নারায়ণগঞ্জের সাংসদ বলেছেন, তিনি কোনো নির্বাচনী সভায় অংশ নেন নি। আর চট্টগ্রামের সাংসদ বলছেন, তিনি তার এলাকায় বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবের সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলছেন, লিখিত অভিযোগ পেলে কমিশনের পরামর্শ অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কবে সে দিন আসবে? নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে সাংসদরা ছাড়াও স্থানীয় সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য আরো ভয়ংকর। তারা বলছে, নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা ছাড়া করা হবে। কবর দিতে দেওয়া হবে না। ধরে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারা হবে। এমন দম্ভোক্তির পর নির্বাচনের আবেদন কি আর থাকে?
শুধু তাই নয়, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যানের সংখ্যাও সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৩ হাজার ৭৫৫ টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ৩৪৮ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০৭ জন। এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের খবরও পাওয়া গেছে। প্রার্থীর স্বাক্ষর জাল করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারে চেষ্টার কথাও শোনা গেছে। এমন চলতে থাকলে আগামীতে আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হবে না। নির্বাচনের নামে বিপুল অংকের অর্থও খরচ হবে না। অথচ নির্বাচন কমিশন নির্বিকার।
শালীনতা, সৌজন্য বোধ, সহ-অবস্থান, পরমত সহিষ্ণুতা, বন্ধু বাৎসল্যতা এখন আর নির্বাচনের মাঠে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠতেই সবাই আগ্রহী। সে কারণেই গত চার ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রায় ৮০ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং পঞ্চম ধাপের নির্বাচনসহ নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতায় দু’শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বাড়িঘরে হামলা, নির্বাচনী অফিস ভাংচুর ও মোটর সাইকেল পোড়ানোয়। অথচ নির্বাচন কমিশন এসব দেখতে পাচ্ছে না। পদক্ষেপ নেয়ার কথাও যেন কথার কথা হয়ে গেছে। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনই শেষ উদ্যোগ। তাদের মেয়াদ শেষ। কাজেই তাদের বিদায়ের এ ব্যর্থতার কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে।