মেয়ে ফেলানী হত্যার বিচার দেখেই যেনো মৃত্যু হয় আমার। এর আগে যেনো আল্লায় আমারে না নেয়। ফেলানীর বিচার যতদিন হয় নাই ততদিন আমি চাইতে থাকমু বিচার। এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম নুরু। তিনি আরও বলেন আমার সামনে নাবালক একটা শিশু, তাকে অমিয় ঘোষ আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, অত্যাচার কইরা, কষ্ট দিয়া মাইরা, তানছানা কইরা ঝুলায়া রাখলো কাটাতারের উপর। ১১টা বছর ধরে মাইয়ার লাইগা কান্তাছি আমি। কিন্তু অমিয় ঘোষের আমি আজ পর্যন্ত শাস্তিডা দেখতে পাইলাম না। সে একটা নাবালগ শিশু মাইরা কীভাবে খালাস পায়?
হ্যাঁ! আজ ৭ জানুয়ারি। ফেলানি হত্যার ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। ফেলানীর এই হত্যাকান্ডে আলাচনার ঝর উঠেছিলো বিশ^জুরে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চৌধুরীহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর গুলিতে নিহত হয় কিশোরী ফেলানী। সে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী এলাকার নুরুল ইসলাম নুরু ও জাহানারা বেগমের মেয়ে। ফেলানির মরদেহ দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা কাটাতারে ঝুলে থাকার পর ২দিনব্যাপী পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ৮ জানুয়ারি বিএসএফ বাংলাদেশি বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে। ৯ জানুয়ারি লাশ ময়নাতদন্ত শেষে তার গ্রামের বাড়ির পারিবাড়িক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। ফেলানির এ খবর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার হলে সাড়া বিশে^ শুরু হয় তোলপার। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ফেলানী। বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মী, সংগঠন এবং বিজিবির পক্ষে থেকেও চাপ প্রয়োগ করা হয় ফেলানি হত্যার বিচারের জন্য। পরে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট কোচবিহারের সোনারী বিএসএফ ছাউনিতে অমিয় ঘোষের বিচার কার্যক্রম শুরু করে দেশটির সরকার। আদালতে স্বাক্ষী দেন প্রত্যক্ষদর্শী বাবা নুরুল ইসলাম নুরু ও মামা আবদুল হানিফ। ভারতীয় দন্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত ক্ষুন এবং বিএসএফ আইনের ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয় অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে। ৫ বিচারকের এই আদালত রায়ে বিএসএফ ১৮১ নম্বর ব্যাটালিয়নের হাবিলদার অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পক্ষে ২০১৩ সালের ৬ আগস্ট অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয়। ফেলানি হত্যার সঠিক বিচার না পেয়ে ২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় হাই কমিশনারের মাধ্যমে পুনরায় বিচারের আবেদন করেন ফেলানির বাবা। পরে বিজিবি-বিএসএফের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পুনঃ বিচারে বিএসএফ সম্মতি দিলে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনর্বিচার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর ফেলানির বাবা নুরুল ইসলাম আদালতে অমিয় ঘোষকে আবারও অভিযুক্ত করে স্বাক্ষ্য প্রদান করেন এবং অমিয় ঘোষের সর্বোচ শাস্তি দাবি করেন। কিন্তু এই বিচারে আদালত আবারও আগের রায় বহাল রাখেন। পরে ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এবং ভারতীয় আইনজীবী অপর্ণা ভাট এর সহাতায় ফেলানি হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাবা নুরুল ইসলাম নুরু। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ভারতের সুপ্রিমকোর্টে করা দুটি রিটের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। শুনানীর পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে হলফনামা দাখিলের জন্য ৩ সপ্তাহের সময় দেয় আদালত।
বিচারের এমন ধীরগতি আর ভারত সরকারের অবহেলায় হতাশ ফেলানীর পরিবার ও স্থানীয়রা। এখনও সঠিক বিচারের আশায় দিন গুনছেন তারা। স্থানীয়দের দাবি সীমান্তে ফেলানী হত্যার সুষ্ঠু বিচার ও হত্যাকারীর কঠিন শাস্তি হলে অনেকটাই কমবে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করা। ফেলানী হত্যার বিচার না হওয়ায় ভারতীয় বিএসএসএফ এর গুলিতে প্রতিনিয়ত ঝওে যাচ্ছে বাংলাদেশি তাজা প্রাণ। তাই দ্রুত ফেলানীর ক্ষুনীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন ফেলানীর স্বজন ও স্থানীয়না।
ফেলানীর ছোট ভাই জাহান উদ্দিন ও আরফান আলী জানায়, বড় আপু ফেলানী যেভাবে তাদেরকে আদও করতেন স্নেহ করতেন এখন আর সেরকগম আদর স্নেহ কেউ করেন না তাদের। বড় আপুর কথা মনে করলে চোখে পানি আসে তাদের। অথচ সেই আদর দেয়া আপুর হত্যার বিচার হলো না আজও। এখনও রাতে বড় বোনের বিচারের আশায় নির্ঘুম রাত কাটে তাদের। ফেলানীর মা জাহানা বেগম বলেন, সন্তান হারানোর বেদনা যে কত কষ্ট। সেটা যার সন্তান চলে গেছে তারাই বুঝবে। তাই আমি অমিয় ঘোষের এমন শাস্তি চাই যে, আমার মেয়ে ফেলানীকে মারার সময় যেবাবে মা মা করে, বাবা বা করে চিল্লাইছে সরকম করে যেনো অমিয় ঘোষও চিল্লায়। তার যেনো ফাঁসি হয়।
কুড়িগ্রাম জেলা জজকোর্ট এর পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাভোকেট এস.এম আব্রাহাম লিঙ্কন বলেন, ফেলানী হত্যার রিটটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে শুনানীর জন্য কার্যতালিকার তিন নম্বর পর্যন্ত উঠেছিলো। পরে করোনার জন্য বিচার কাজ আটকে যায়। তবে ভারতের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে ভারত সরকারের উচিত দ্রুত বিচারের রায় দেয়া।