ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা পঞ্চগড়ে দিন দিন মাদকের ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। নতুন নতুন মাদক ব্যবসায়ীর পাশাপাশি বেড়েছে নতুন নতুন মাদকসেবীর সংখ্যাও। মাদক ব্যবসায়ীরা সু-কৌশলে মাদক তুলে দিচ্ছে মাদক সেবীদের হাতে। শহরে মাদকের সহজলভ্যতার কারণে শিশু, কিশোর, যুবকসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে সামাজিক বিশৃংখলার সাথে মেধাহীন হয়ে পড়ছে আগামী প্রজন্ম।
জানা গেছে, চার-তৃতীয়াংশ ভারত বেষ্টিত জেলা পঞ্চগড়ে জোয়ারের পানির মত আসছে ভারতীয় মাদকদ্রব্য। সীমান্ত পেরিয়ে আসা মাদকের চালান আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে জেলার চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এবং থানা পুলিশের নিয়মিত ও বিশেষ অভিযানে দু-চারজন ধরা পড়লেও আড়ালে থেকে যায় মূল ব্যবসায়ীরা। তারা বিভিন্ন কৌশলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা।
দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের জুন মাস থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় হঠাত মূল্য বৃদ্ধি পায় ভারতীয় ফেনসিডিলের। এতে ফেনসিডিলে আসক্তরা ঝুকে পড়ে ইয়াবা, হিরোইন, পেথিডিনসহ অন্যান্য মরণ নেশায়। এ ধরণের মাদক সেবনের কারণে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মাদকসেবীরা। লাভজনক হওয়ায় ইয়াবা, হিরোইন ও পেথিডিনের ব্যবসায় জরিয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এছাড়াও শহরের একাধিক ফার্মেসীতে সিনটা, সিনামিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ওষুধ সংগ্রহ করে নেশা করছে উঠতি বয়সের ছেলেরা। এতে আসক্তের পরিবারের পাশাপাশি সমাজেরও ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। মাদকের টাকা জোগাতে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন অপরাধে জরিয়ে পড়ছে মাদকসেবীরা।
সূত্র মতে, আইন-শৃংখলা বাহিনী সাধারণত মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তায় চুনো-পুঁটি দু-চারজন মাদক সেবীদের আটক করে থাকেন। যা মাদকদ্রব্য রোধে বা সহজলভ্যতা দূরীকরণে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না। সম্প্রতি জেলায় হঠাত করে হিরোইনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণ ও এর উৎস বের করতে অনুসন্ধান চালানো হয়। ঝুঁকে পড়ার কারণ হিসেবে ফেনসিডিল সরবরাহ কম ও এর মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সহজেই উঠে এলেও এর উৎস খুঁজতে তিক্ত অভিজ্ঞতায় পড়তে হয় এক অনুসন্ধানী সাংবাদিককে। আর এই তিক্ত অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে যে, মাদক ব্যবসায়ীদের একটি নিবির সর্ম্পক বা বুঝাপড়া রয়েছে পুলিশের সাথে। ডোমারের অচিনতলা নামক এলাকায় হিরোইন ডিলারের তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে সাদা পোশাকধারী এক দল পুলিশের বাঁধার মুখে পড়তে হয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদককে। এরপর পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় ফেলে রাখা একটি পলিথিনের পোটলা তুলে এনে ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের নামে মামলা দেয় বোদা থানা পুলিশ। পরিবেশ পরিস্থিতি বা প্রয়োজনে এরা একে অপরকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হয়ে থাকেন।
বর্তমানে সদর উপজেলার হাড়িভাসা, কহুরুরহাট সীমান্ত এলাকা, বোদা উপজেলার তেপুকুরিয়া ও মাড়েয়া থেকে মাদক চোরাচালান করা হয় বলে জানা গেছে। যদিও পঞ্চগড়ে ইয়াবা ও হিরোইনের অধিকাংশ চালান আসছে পাশ্ববর্তী নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা ও ঠাকুরগাঁও জেলার ভুল্লী নামক এলাকা থেকে। এসব নেশাদ্রব্য মাদকসেবীদের হাতে তুলে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন মাদকস্পট।
সরেজমিনে জানা যায়, পঞ্চগড় শহরের রাজনগর এলাকায় একজন মাইক্রো ড্রাইভার দীর্ঘদিন ধরে হিরোইন ও ইয়াবার ব্যবসা করে আসলেও আজও আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েনি। তিনি আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা না পড়তে নিয়মিত ধরিয়ে দেন মাদকসেবীদের। দীর্ঘদিন ধরা না পড়ায় বর্তমানে তিনি মাদকসেবীদের কাছে মাদক স¤্রাট হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। একই এলাকায় বকুলতলা সুইপার পট্টিতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় গাঁজা। এছাড়াও শহরের রামেরডাঙ্গা, ট্রাক-টার্মিনাল এলাকায় ইয়াবা, হিরোইন এবং ধাক্কামারা ও কমলাপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ফেনসিডিল বিক্রি করে আসছে একাধিক চক্র।
সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন জানান, মাদকের সহজলভ্যতার কারণে সন্তানদের মাদকাসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্ত সন্তানকে মাদকের কালো থাবা থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোটের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে জেল-হাজতে বা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হলেও ফিরে এসে আবারও আসক্ত হয়ে পড়ছে। সমাজকে মাদক মুক্ত করতে প্রশাসনকে প্রথমে মাদকের সহজলভ্যতা দূর করতে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে পঞ্চগড় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী মুঠোফোনে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জেলা পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যা জেলা পুলিশের ফেসবুক পেইজে নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে আগামীতেও এধরণের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।