অভাব অনাটনে এমনও দিন গেছে পরিবারের সদস্যদের দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের যোগান দিত পারিনি। লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারিনি। আমি যখন এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গেছি সকালে পরের জমিতে কৃষাণ দিয়ে খরচের টাকা জোগাড় করে পরীক্ষা দিতে যেতাম। সংসারের হাল ধরতে চাষাবাদকে পেশা হিসাবে বেছে নেই। এখন পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। এবার কুড়ে ঘরের পরিবর্তে দো'তালা বিল্ডিং নির্মাণ করার আশা আছে। বিদ্যুতের সুবিধা না পেলেও বাড়িতে লাগিয়েছিলাম সৌরবিদ্যুৎ। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে এখন আর চিন্তা করতে হয় না। উচ্ছে করলা চাষে আমার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। হাসি মুখে কথাগুলো এফএনএসকে বললেন খুলনার পাইকগাছায় গড়ইখালী ইউনিয়নের কুমখালী গ্রামের কৃষক নিমাই সানা। তিনি উচ্ছে চাষ করে আজ হয়েছেন সাবলম্বী। সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে প্রতিবছর ১বিঘা জমি ক্রয় করে বর্তমানে ১২ বিঘা জমির মালিক। মা-বাবা, স্ত্রী, ১ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। এ বছর নিজ সাড়ে ৯ বিঘা জমিতে উচ্ছে, ২ বিঘা জমিতে ধান, ১০ কাঠায় ডাউল, দেড় বিঘা জমিতে মিষ্টি কুমড়া, ২ বিঘাতে তরমুজ সহ অন্যান্য শাকসবজি চাষাবাদ করেছেন। রবি মৌসুমে ডায়মন্ড বোল্ডার জাতের উচ্ছে চাষে এ সফলতার মুখ দেখেছেন নিমাই সানা। সাবলম্বী কৃষক নিমাই সানা বলেন, অভাব অনাটনের সংসারে রুটিরুজি জোগাড় করতে যখন দিশেহারা। ঋণে জর্জরিত। সংসারে স্বচ্ছতা আনতে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাধক ঢালীর পরামর্শ ও সহযোগিতায় নিজ ১২ বিঘা এবং ৪ বিঘা বর্গা মোট ১৬ বিঘার মধ্যে সাড়ে ৯বিঘা জমিতে উচ্ছে এবং ঢেঁড়স, বীণা স্বাদ ধান, মিষ্টিকুমড়া সহ অন্যান্য সবজি চাষ করেছি। নিজস্ব জমিতে চাষাবাদ করেছি বিধায় ব্যয়ের তুলনায় অধিক আয় লাভ সম্ভব হচ্ছে বলে জানান নিমাই সানা। এই সবজি চাষের উপর তার সংসারের ভরণ পোষণ হয়। উচ্ছে বিঘা প্রতি উৎপাদনে ১৩/১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদিত ২০ মণ উচ্ছে ৭০/৮০ হাজার টাকা বিক্রয় করেছেন। সপ্তাহে তিনি ৭৫/৮৫ মণ উচ্ছে ক্ষেত থেকে বিক্রয় করেছেন। এখন আর তাদের জমির ফসল বিক্রি করতে হাটে যেতে হয় না। পাইকাররা ক্ষেতে এসে টাটকা সবজি কিনে নিয়ে যায়। এ সবজি ৩ হাত বদল হয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায়। রাসায়নিক মুক্ত সম্পূর্ণ জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে সে সবজি উৎপাদন করে। এতে খরচ কম, লাভ বেশী এবং এই সবজি খেতেও সুস্বাদু। পোকামাকড় দমনে ফেরোমন ফাঁদ সহ আলোর ফাঁদ ও আটা সমৃদ্ধ হলুদ কার্ড ব্যবহার করেন। সেখানে পোকা বসলে মারা যায়। তিনি আরো বলেন, এবছর বৃষ্টি না হওয়ায় খরার কারণে, জলের অভাবে প্রত্যাশা মত ফলন পাইনি। না হলে আরো বেশী ফসল উৎপাদন করা যেত। এজন্য তিনি বদ্ধ নদী, খাল খনন, ১৫/১৬শ ফুট ডিপটিউবয়েল বসানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। উপজেলা কৃষি সাম্প্রসারণ অধিদফতর যেভাবে তাকে সাহায্য ও সহযোগীতা করছে তা যদি আগামীতে ও অব্যাহত রাখে তাহলে সে কৃষি কাজে সাম্প্রসারণ করা সহ নতুন নতুন পদ্ধতিতে ফসল ফলাতে পারবে। এ ছাড়া উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ ও সহযোগিতায় গত বছর উচ্ছে পাশাপাশি তরমুজ ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করেও সে ব্যাপক ভাবে লাভবান হয়েছিলিন। এদিকে নিমাই সানার আত্ম কর্মসংস্থানমূলক এই কৃষি কার্যক্রম দেখে এলাকার সাধারণ মানুষ ও অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকও কৃষি কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাধক ঢালী এফএনএসকে বলেন, উচ্ছে চাষে বেশি লাভ পাওয়ায় এবং মাটি ও পরিবেশ অনুকূলে থাকায় কৃষকরা উচ্ছে চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। লাভজনক এ চাষ সম্প্রসারণ করা হবে। তবে এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়া, জলের অভাবে গাছ ও ফলন কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে কৃষি বিভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার মডেল হিসাবে কুমখালী গ্রামের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা নিমাই সানা কাজ করে যাচ্ছে। এখানে জৈবিক উপায় ফসল ফলানোর জন্য পোকামাকড় দমনের ক্ষেত্রে ফেরোমন ফাঁদ, ইউলাইস্টেকার ব্যবহার করা হচ্ছে। যেখানে পোকা আকৃষ্ট হয়ে মারা যাবে। ক্ষেতে কোন রাসায়নিক কিটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। সম্পূর্ণ জৈবিক উপায়ে ফসল ফলানো হয়। এতে খরচ কম লাভবান বেশি। আমারা কৃষি বিভাগ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি নিরাপদ এবং নতুন নতুন আইটেমের সবজি উৎপাদনের জন্য। চাষিদের জন্য আমাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ সব সময় অব্যাহত আছে, থাকবে।