সম্প্রতি বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক দেশগুলোকে নিজেদের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা এবং সত্যিকারের বহুত্ববাদ সুরক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে চীন। পাশাপাশি চীন এসব দেশকে ‘স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতা এবং ব্লক বা গোষ্ঠী রাজনীতি’ পরিহার করারও আহ্বান জানিয়েছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়াবিষয়ক মহাপরিচালক লুই জিনসং। চীনের এমন আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছেÑবাংলাদেশ কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি প্রতিপালন করবে, সে বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছে চীন। সংবাদমাধ্যম সিজিটিএনের নিবন্ধে বলা হয়েছ, এ মুহূর্তে এটা বোঝা জরুরি যে, লুই জিনসং তাঁর আহ্বানের মাধ্যমে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন; আঞ্চলিক দেশগুলোকে চীন কেন ব্লক রাজনীতিতে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং এসব দেশের কোনো পক্ষের সঙ্গে জড়ানো আদৌ উচিত কি না। রাষ্ট্রনীতি ও কৌশল-বিষয়ক বোদ্ধারা একুশ শতককে ‘দ্য এশিয়ান সেঞ্চুরি’ বা ‘এশিয়ার শতক’ বলে অভিহিত করে থাকেন। মহাদেশটি এর অর্থনীতি ও জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতির ক্রমবর্ধমান ধারার মধ্য দিয়ে বিশ্বে কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলে বোদ্ধারা মনে করছেন। তাই, এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের গাঢ় সম্পর্ক এবং দেশটির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কাÑচীন হয়তো আঞ্চলিক দেশগুলোর ওপর নিজের প্রভাবকে ব্যবহার করে ভূরাজনীতিতে বড় কিছু হাতিয়ে নিচ্ছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরী অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাবের রাশ টানতে এবং মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চীনকে নিশানা করে স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ অঞ্চল ঘিরে কৌশলে চীনকে বাদ দিয়ে গড়া তিন জোটÑট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি), ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) ও ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) যে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধকালীন মানসিকতারই প্রমাণ দিচ্ছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে প্রথম স্নায়ুযুদ্ধকালের মতো যুক্তরাষ্ট্র একইভাবে এখন এশীয় দেশগুলোকে চীন কিংবা তাদের পক্ষভুক্ত হতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ দিচ্ছে। এ বিষয়টি চীনের মেনে নেওয়া কথা নয়। উল্লিখিত বিশ্লেষণ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, কেন চীন চায়Ñব্লক রাজনীতির ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি থেকে আঞ্চলিক দেশগুলো দূরে থাকুক। এ ছাড়া কেন চীন এ অঞ্চলে ‘ব্লক রাজনীতি’ সমর্থন করে না, তা বোঝানোর জন্য বহু কারণের কথাও বলা যায়। প্রথম কারণÑএশীয় দেশগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার নতুন স্নায়ুযুদ্ধের কোনো এক পক্ষ নেয়, তাতে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। শুধু তা-ই নয়Ñএশীয় অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধিও হুমকির মুখে পড়বে। দ্বিতীয়ত, এশীয় দেশগুলো এ ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে শামিল হলে বিশ্ব দুপক্ষে ভাগ হয়ে যাবে। তখন এশিয়ার বাইরের বাকি দেশগুলোর এ দুপক্ষের কোনো একটিতে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। অন্যদিকে, এশীয় দেশগুলো নির্দিষ্ট কোনো ব্লকে যোগ না দিলে মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র তার এখনকার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। তৃতীয়ত, এশিয়ার দেশগুলো যদি এ অর্থনৈতিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকে, তাহলে তাদের জন্য নিজেদের মধ্যকার বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় মতানৈক্যগুলো মিটিয়ে ফেলা সহজ হবে। চতুর্থত, প্রতিটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্রের নিজ নিজ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থান ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ এবং সে লক্ষ্যে এগোনোর অধিকার রয়েছে। কিন্তু, এশিয়ার দেশগুলো নতুন স্নায়ুযুদ্ধে শামিল হলে, তাদের জন্য বিষয়গুলো কঠিন হয়ে পড়বে। কেননা, তখন দেশগুলোর নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তে বিশ্বশক্তির নেতৃত্বাধীন ব্লকের এজেন্ডাই বাস্তবায়নে মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। পঞ্চমত, বহু বছর ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার কারণে এশিয়ার বেশির ভাগ দেশকে আর্থসামাজিক নানা সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ বুঝতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। ষষ্ঠত, সুনির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শকে সমর্থন না দিয়ে এসব দেশের বরং বিশ্বে আরও সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা উচিত। সপ্তমত, স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা না রেখে এশিয়ার দেশগুলোর উচিত হবেÑনিজেদের ভূমি, অভ্যন্তরীণ বাজার ও জনশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বৃহত্তর সহযোগিতায় আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করা। অষ্টমত, এশিয়ার দেশগুলো যদি পক্ষদুষ্ট হয়ে পড়ে, তাহলে তা কোনো একদিন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে গড়াতে পারে, এমনকি তা পরমাণবিক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। আর তখন, কেবল এশিয়াই সবচেয়ে বেশি ভুগবে; ঠিক যেভাবে স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইউরোপ ভুগেছে কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যেভাবে মহাদেশটিকে ভুগতে হচ্ছে। এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর উচিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্যাটেলাইট স্টেট’ (কাগজে-কলমে স্বাধীন দেশ) না হয়ে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করা। চীনের সমৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে তার একক আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এ উদ্দেশ্য হাসিল করতে ওয়াশিংটন এশিয়ার দেশগুলোকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানোর চেষ্টা করছে। আর, যুক্তরাষ্ট্র এ লক্ষ্যে যেসব কৌশল অবলম্বন করেছে, তা এরইমধ্যে ভুল ও অনুপযুক্ত প্রমাণ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়Ñআইপিএস-এর অর্থনৈতিক অসংগতির জেরে এশীয় দেশগুলোকে নিজেদের ব্লকে টানতে যুক্তরাষ্ট্রকে আইপিইএফ গঠন করতে হয়েছে। (কিন্তু,) আইপিইএফে কোনো অগ্রাধিকারমূলক বাজারে প্রবেশাধিকার কিংবা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নেই। ফলে এটিরও ব্যর্থ হওয়াই ভবিতব্য। যুক্তরাষ্ট্রের মনে রাখা উচিতÑসাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যেসব মার্কিন কৌশল ইউরোপে কাজে দিয়েছে, সেসব কৌশল ভিন্ন ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে খাটবে না। ১৯৫৪ সাল থেকে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচ নীতি’ মেনে চীন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘নাক না গলানো’র চর্চা করে আসছে। চীন জানে, এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো ব্লক রাজনীতিতে যুক্ত হলে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ তীব্রতর হবে। তখন সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে এবং নিরাপত্তা ব্যাহত হবে, অশান্তি বাড়বে। এতে করে জনগণের জীবনযাপন আরও কষ্টকর হয়ে পড়বে। (তাই), দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য চীন ‘ব্লক রাজনীতির’ মানসিকতা থেকে দূরে থাকতে আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।