স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সড়কপথে দক্ষিণাঞ্চল থেকে মানুষজন রাজধানীতে আসা-যাওয়া করায় পূর্বের চেয়ে নৌরুটে যাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু হয়ে স্বল্পসময়ে ঢাকায় যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হওয়ায় এখন অধিকাংশ মানুষ সড়কপথে সুবিধা গ্রহণ করায় প্রভাব পরেছে নৌরুটে।
বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে লঞ্চযাত্রা নিরাপদ এবং আরামদায়ক, এনিয়ে জনশ্রুতি থাকলেও যাত্রীরা সড়কপথে পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানীমুখী হওয়ায় অনেকটা চিন্তিত হয়ে পরেছেন নৌযান মালিকরা। যদিও নৌ-পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেতু চালু হওয়ার পর বরিশাল-ঢাকা রুটে যাত্রী চাপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এনিয়ে টেনশনের কিছু নেই। এখন কিভাবে যাত্রী ধরে রাখা যায় সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের এই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে লঞ্চ মালিকরা নতুন কৌশলও অবলম্বন করেছেন। সেক্ষেত্রে যাত্রীদের কাছ থেকে গত কয়েকদিন ধরে ভাড়া কমিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
নৌ-পরিবহন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধণের পর ২৬ জুন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হলে ক্রমাগতভাবে লঞ্চে যাত্রীদের চাপ কমতে থাকে। আগে প্রতিদিন ৮/১০টি লঞ্চ যাত্রীবোঝাই করে প্রতিদিন সন্ধ্যারাতে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেলেও সেই সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ফলে লোকসানের ভাবনায় লঞ্চ মালিকরা এখন বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে লঞ্চের সংখ্যার পাশাপাশি ভাড়াও কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও মিলছে না কাঙ্খিত যাত্রী। পূর্বে দালালছাড়া লঞ্চের কেবিন পাওয়া যায়নি। অথচ বর্তমানে অধিকাংশ কেবিন যাচ্ছে খালি। এনিয়ে লঞ্চ মালিকরা বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।
লঞ্চ মালিকদের একটি সূত্র জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু চালুতে নৌরুটে প্রভাব পরায় যাত্রী ধরে রাখতে মালিকরা নয়া কৌশল হিসেবে অনানুষ্ঠানিকভাবে ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন। সিঙ্গেল এসি কেবিন এতোদিন ১৪শ’ টাকা করে নেয়া হলেও বর্তমানে তা কমিয়ে এক হাজার, এসি ডাবল কেবিন ২৮শ’ টাকার পরিবর্তে দুই হাজার এবং ডেকের ভাড়া ৩৫০ থেকে কমিয়ে দুইশ’ টাকা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নন এসি সিঙ্গেল আটশ’ এবং ডাবল ১৫শ’ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। গত দুদিন ধরে এই ভাড়া নেয়া হলেও লঞ্চগুলোতে যাত্রী নেই বললেই চলে।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন লঞ্চ মালিক বলেন, ভাড়া কমিয়েও গত দুইদিনে লঞ্চে তেমন যাত্রী আসা-যাওয়া করেননি। সামনে ঈদ-উল আযহা, প্রতিবছর এই সময়ে লঞ্চের কেবিনের টিকিট সংগ্রহের জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকার পাশাপাশি মালিকদের থাকতো স্পেশাল সার্ভিসের নানামুখী প্রস্তুতি। কিন্তু এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে টিকিটের চাহিদাতো নেই, পাশাপাশি মালিদেরও কোন তৎপরতা নেই।
লঞ্চ মালিকদের বড় একটি অংশের দাবি, নিরাপাদ এবং আরামদায়ক যাত্রার ক্ষেত্রে লঞ্চের কোনো বিকল্প নেই। লঞ্চ যাত্রায় পরিবার-পরিজনদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করা যায়। তবে লঞ্চ মালিকদের কেউ কেউ বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় লঞ্চে পূর্বের সেই যাত্রী চাপ আর দেখা যাবেনা। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বরিশাল থেকে মাত্র পৌনে তিন ঘন্টায় পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানী যাওয়া আসা করা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সকালে রওনা দিয়ে সারাদিন কাজ সেরে রাতে আবার বরিশাল ফিরতে পারছেন।
কেন্দ্রীয় লঞ্চমালিক সমিতির সহ-সভাপতি এবং বিলাসবহুল সুন্দরবন নেভিগেশন কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধণ হয়েছে এক সপ্তাহও হয়নি, তাই অনেকেই আগ্রহ নিয়ে সেতু দেখতে গিয়ে সড়কপথে রাজধানীগমন করছেন। ফলে নৌরুটে কিছুটা প্রভাব পরেছে। কিন্তু এটা ক্ষণিকের জন্য, লঞ্চযাত্রা জনপ্রিয় হওয়ায় এর চাহিদা আছে এবং থাকবে। তবে যাত্রী ধরে রাখতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য তিনি লঞ্চ মালিকদের আন্তরিক হতে হবে জানিয়ে বলেন, বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের বেশ কয়েকটি অংশে নাব্যতা রয়েছে, সেগুলো ড্রেজিং করে নদীর গতিপথ ঠিক রাখলে লঞ্চযাত্রা কখনও জৌলুস হারাবে না।
পদ্মা সেতু চালুর পরে নৌ-রুটে যাত্রী কমে যাওয়া এবং মালিকেরা ভাড়া কমিয়ে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বরিশাল নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত কয়েকদিন থেকে লঞ্চগুলোতে যাত্রীসংখ্যা খুবই কম। লঞ্চের কেবিনও খালি গেছে। তবে তিনি আশাবাদী লঞ্চ মালিকরা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে এতোদিন যারা লঞ্চে যাতায়াত করেছেন, সেইসব যাত্রীদের ধরে রাখা সম্ভব হবে।
নদীর নাব্যতাসংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছরই নদীতে ড্রেজিং হচ্ছে, তারপরেও কোথাও কোথাও নাব্যতা দেখা দেয়। নদীর গতিপথ ধরে রাখতে সরকার সংশ্লিদের আন্তরিকতার কমতি নেই। ইতোমধ্যে এই অঞ্চলের নদীপথে যেখানে যেখানে নাব্যতা রয়েছে তা চিহ্নিত করে ড্রেজিং করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।