উনবিংশ শতাব্দীর কথা। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীতে ভাসমান জেলেনী পরিবারগুলোকে একহাত ও একপাঁ দিয়ে নদীর জলে নৌকা ভাসিয়ে মাছ শিকারে দেখা যেতো নেছারাবাদে ূতিন যুগ আগেও। আধুনিক সভ্যতায় এ দৃশ্য বিলীন হতে চলছে। নৌকায় বসতবাড়ি এমনই কতগুলো মাছ শিকারি জেলেনীদের পরিবার খোলা আকাশের মুক্তপল্লীর অবারিত বাতাস গতানুগতিক হাসি- কান্না, আশা-নিরাশা, কথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ তাদের মাঝে থাকলেও স্বাভাবিক পল্লীর নারীদের সঙ্গে এদের কোনো মিল নেই। অভাবের দুঃসহ যন্ত্রণার শিকার এসব জেলেনীদের অধিকাংশ নারী। “ওরা গরিবের মধ্যে আরো বেশি গরিব”নারী সমাজের ভাসমান নারী জেলেনীর ছৈয়ালা টাবুরিয়া নৌকাগুলোর একমাত্র উপার্জনের প্রধান যখন নারী, তখন আনন্দ-উৎসব তো বটেইÑ মুখের দেখাও যেন তাদের ভাগ্যে জোটে না। হাজেরা বেবী, মঙ্গলজান বিবি, সুফিয়া বেগম, কুলসুম বিবি ও ছকিনা বেগম এ অবস্থারই বাস্তব উদাহরণ। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশে^র একটি দেশে ন্যূনতম জীবনধারণ উপকরণের সুবিধা থেকে যেখানে অর্ধেকের বেশি পুরুষপ্রধান পরিবার বঞ্চিত, সেখানে নারীপ্রধান পরিবারের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। এখানে নারীপ্রধান পরিবার বলতে বোঝায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম একজন নারী। তা সে তালাকপ্রাপ্ত, বিধাব কিংবা অবিবাহিত হতে পারে। এই ভাসমান নারী জেলেনী পরিবারগুলো এরই একটি বাস্তব চিত্র। ভাসমান পরিবারগুলোর এক পরিবারপ্রধান ও মাছ শিকারের দলপ্রধান পক্ষী নামক নৌকার মালিক কালকিনি উপজেলার কাছিকাটা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বিবি কুলসুম বেগমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, এখানের প্রতিটি নারীই মেছুয়া, ম্বামীকর্তৃক কোনো না কোনো ঘটনায় আজ তারা এ পেশায়। যৌতুকলোভী স্বামীর নির্যাতন, পুরুষ কর্তাহীনতার কারণ, কম বয়সে অভাবী পরিবারে স্বামী পরিত্যক্ত, নদী ভাঙন ও একমাত্র উপার্জনকারী স্বামীর মৃত্যুর কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে স্বরুপকাঠির (নেছারাবাদ) সন্ধ্যানদীর ফেরিঘাট সংলগ্ন পাড়ে সমবেত হচ্ছে এ মৎস্যজীবী নারীরা। এদের মধ্যে কিশোরী, তরুণী, বিবাহিত, অবিবাহিত বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী নারী রয়েছে। বিবাহিত নারী মেছুয়াদের অধিকাংশের সন্তান রয়েছে। নদীর জলের উপর ঝড়-বণ্যার বিভীষিকা (আতঙ্ক) কে হার মানিয়ে মাছ শিকার করাই ওদের প্রতিদিনের কাজের রুটিন। নদী কিংবা সাগরে মাছ শিকার করে চলে তাদের সংগ্রামী জীবন- সংসার। যে জলে তাদের ওপর তাদের বসবাস সেখানেই আবার মরণ নিয়তি তাদের। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এ পেশায় জড়িত থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো ধরণের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই তারা সকলেই মানতা সম্প্রদায় নামে পূর্বপরচিত। এই মানতা সম্প্রদায় দরিদ্রদের তালিকায় থাকলেও সবচেয়ে বেশী দরিদ্র। সাধারণ মানুষের চেয়ে ভাসমান জেলেনীদের জীবন-যাত্রা বিপন্ন। ছোট্ট নৌকাটিতেই ওদের জম্ম-মৃত্যু-বিয়ে ও ঘর-সংসার, পৃথিবী। তবে পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে এসব নারী রোজগারের প্রতি যতটা সচেষ্টা হতে পারছে না, ততটা সচেষ্ট হতে পারছেন না সন্তানকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ব্যাপারে। জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত এসব মায়ের সন্তানরা বাধ্য হয়ে এক অনিশ্চিতঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন করছে। যে পরিবারের মানুষগুলোর জন্য অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসা, বাসস্থানসহ কোনো মৌলিক চাহিদাই জুটছে না বুভুক্ষু মানতা সম্প্রদায় দরিদ্র এসব মানুষের ভাগ্যে। এমনই এক পল্লী গড়ে উঠেছে পিরোজপুরের জেলাধীন স্বরুপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলার সন্ধ্যানদীর পাড়ে। এখানে ৫১টি পরিবােেরর ৫১টি ছৈয়ালা নৌকায় ১৫৭ জন সদস্য ভোর হতে না হতেই যে যার মত মাছের সন্ধানে বিভিন্ন নদ-নদীর উদ্দেশ্যে ছুটছে তো ছুটছেই। আবার পড়ন্ত বিকালের শেষ মূহূর্তে লাল সূর্য অন্ত যাওয়ার আগেই দশ-বারো হাত লম্বা নৌকাগুলো তাদের নির্দিষ্টস্থান ফেরিঘাটে এসে হাজির হয়। এরপর সংসারী কাজ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার অবলোকন করাটা যেন এখানকার মানুষের একটি রীতিমতো নিয়মে পরিণত হয়েছে। ছৈয়াল কোষা নৌকায় রয়েছে সোমত্ত মেয়েও, তবে কখনো বিরুপ কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হন না তারা। ছোট ছোট খাঁচার মধ্যে বাতি জ¦ালিয়ে প্রতিটি নৌকায় চলছে রান্না-বান্নার কাজ। নৌকায়, নদীর ও চরে বাচ্চাদের ছুটাছুটি দেখে মনে হয় নৌকার মাঝেই যেন ওদের খেলার মাঠ। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে মনের আনন্দে বিভিন্ন খেলাধুলায় মেতে আছে শিশুরা। রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া শেষে কেউবা ছেঁড়া জাল বুনছে, কেউবা গান শুনিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পড়াচ্ছে, আবার কোনো কোনো নৌকায় দেখা যাচ্ছে পাঁচ-ছয় জন সারিবদ্ধ হয়ে পানের টোপলা মুখে অতীতের গল্পে মেতে উঠেছে। লম্বা কোষা নৌকাটিই যেন তাদের ঘরবাড়ি, থাকা,খাওয়া-দাওয়া,রান্না-বান্না,আনন্দ-ফুর্তিও,আবাস।নারীসমাজের নারীপ্রধান পরিবারগুলোর মধ্যে যেসব পরিবার চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে, ভাসমান নারী জেলেনী তারই অন্তর্ভুক্ত। একটু সুখ-সচ্ছলতার আশায় ওরা উত্তাল নদীতে মাছ শিকার করে আজীবন। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাই তাদের একমাত্র অবলম্বন। ছোট ছোট নৌকায় বসবাস হলেও তাদের সংসার ছোট নয়। এ ব্যাপারে দিনাজপুরের আমেনা বেগম জানান, প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে ৩ থেকে ৬টি সন্তান। নৌকাপ্রতি দৈনিক তিন শত থেকে চাঁর শত টাকার বেশি আয় হচ্ছে না। তবে সময়ে বিশেষ মাছ বেশি পেলে আয় ভাল হলেও তা মাসে দু‘ই/এক দিন। তবে এ সীমিত আয়ের কারণে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে প্রতিনিয়ত। তাদের কোনো মুখী পরিবার নেই বললেই চলে। কারণ পরিবার পরিকল্পনার ছোঁয়াই তাদের সমাজে লাগেনি, সু-চিকিৎসার অভাবে রোগবালাই লেগেই আছে। মানতা সম্প্রদায় শিক্ষিত না হওয়ায় এবং জম্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অজ্ঞতার দরুণ তারা জম্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে না বিধায় দিন দিন এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাল্যবিবাহ ও বহু বিহু বিবাহ তাদের অন্যতম রীতি। জামালপুরের সুফিয়া বেগম বলেন, একসময় তারা কারেন্ট জাল পেতে জাটকা ধরতো, তাতে তাদের বেশ আয় হতো। কিন্তু বর্তমানে সুতার জাল দিয়ে মাছ ধরছে, যার কারণে আগের চেয়ে মাছ কম পাওয়ায় আয়ও কম হয়। তিনদিন ধরে মাছ পায়নি আমেনা পরিবারের নৌকার সদস্যরা। ক্ষুধার দুঃসহ যন্ত্রণায় চলছে তাদের দিনগুলো। অন্য এক নৌকার মালিক এবং নৌকার পাশাপাশি তীরে ডেরা তৈরি করে বাস করছে মঙ্গলজান বিবি(৭০)। ছোট দু‘ই ছেলে, দু‘ই মেয়ে আর শত বছরের বৃদ্ধা মা দূত মেহেরবানুকে নিয়ে তার পরিবার। স্বামী মঙ্গল সরদার ১৮ বছর আগে মারা গেছেন। বড় ছেলে বিয়ে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে আলাদা নৌকায় সংসার। মাছ শিকারে রৌদ-বৃষ্টি, বন্যার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে অতিকষ্টে কাটছে তার দিনগুলো। এমনই আরেকটি নৌকা রয়েছে ফরিদপুরের নাজমা বিবির। তার নৌকায় ২ থেকে ৮ বছরের ৪টি শিশুসন্তান রয়েছে। এক বছর আগে এক মেয়ে ৩টি ছেলে সন্তান নিয়ে নাজমা(৪৭) স্বামী পরিত্যক্ত হয়েছে যৌতুকের কারণে। গত জানুয়ারী মাসের ২৮ তারিখ স্বরুপকাঠির ফেরিঘাটে অবস্থানরত ভাসমান জেলেনীদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। তাদের সহযোগিতায় ১০ হাতি একটি ছৈঁয়াল কোষা নৌকা ক্রয় করে। তাদেরই রুটিন অনুযায়ী বিভিন্ন নদ-নদীতে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত হন তিনি। পাঁচ বছরের শিশুটিও নদীতে জাল পাতার কাজে সহযোগিতা করছে তার মা ও ভাইকে। এই ভাসমান নারীপরিবারের সন্তানরা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কখনোই নৌকা থেকে কূলে ওঠে না। নৌকাই যেন বাসস্থানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঘর আর সন্ধ্যার ফেরিঘাটটি যেন তাদের বাড়ি। এ পেশার নারীদের এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। নদীতে জাল পেতে মাছ ধরছে শতাধিক নারীরা। বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ওদের জালে যে সব মাছ মিলতো টেংরা, চিংড়ি, বাঁশপাতা, আইর, টুনা, রুই, কাতল, ক্যাভিয়ার, সার্ডাইনস, স্যামন, ম্যাকরল, রুপচাদঁ, পাঙ্গাস, পোয়া, ফ্যাসা, ফুটনি পুঁটি, গরাই, খাকসাসহ হাজারও মাছ বিক্রির টাকাই ছিল জেলেনীদের জীবন জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। আধুনিক সভ্রতায় মানুষ যেখানে উন্নত জীবন-যাপন করছে ঠিক সেখানে ভাসমান নারী জেলেরা অভাবের তারণায় অর্থ উপর্জনের পরিবারের প্রধান হিসাবে সংসার চালাতে প্রচন্ড শীতেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব মাছ শিকারে বিভিন্ন নদীতে।