শিক্ষানুরাগী রেজাউল করিম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স শেষ করে গ্রামীন ব্যাংকের এরিয়া ম্যানেজারের চাকুরী করতেন। ২০০৪ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে সাড়া দিয়ে চাকুরী ছেড়ে বাড়িতে চলে আসেন। নিজ গ্রাম ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কেয়াবাগান,আগমুন্দিয়া,বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া, হাজিপুর মুন্দিয়া পাশাপাশি এ ৪ গ্রামের মাঝখান কেয়াবাগান মাঠের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আছাদুজ্জামান হোসনি আদর্শ কলেজ কেয়া বাগানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহন করেন। এরপর একদিকে কলেজটির অফিসিয়াল ব্যবস্থাপনা ও অন্যদিকে অবকাঠামোর উন্নয়নের পিছে নিজে ছুটেছেন ১৮ বছর। গত এমপিওতে কলেজটির কারিগরি শাখা এমপিওভুক্ত হলেও তিনি সাধারন শাখাতে থাকায় বেতনের মুখ চোখে দেখেননি। এদিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কলেজটিতে নেয়া হয় না শিক্ষার্থী বেতন। ফলে শিক্ষক কর্মচারীরা কোন আর্থিক সুবিধা পান না। এমন অবস্থার মধ্যে পরিবারের ভরন পোষন চালাতে হিমশিম খান তারা। সব পরিবারের আশা কলেজটি এমপিওভুক্ত হলে সব দূর হবে। এমন অবস্থার মধ্যদিয়ে গত বুধবার ভোরে শিক্ষক দিবস ২২ এর আগের দিন সকলকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেলেন অধ্যক্ষ রেজাউল করিম। একদিন পরে গত বৃহস্পতিবার ছিল শিক্ষক দিবস। ফলে এ দিবসে প্রয়াত শিক্ষক রেজাউল করিমের পরিবার ছিল কান্নার মধ্যে।
কলেজের প্রভাষক জামির হোসেন জানান, অধ্যক্ষ রেজাউল করিম ছিলেন একজন গুণী শিক্ষক। কলেজে বিগত ১৮ বছর তারা বিনা বেতনে চাকুরী করছেন। এজন্য তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে চরম অভাবের মধ্যদিয়ে দিনযাপন করতে হয়। এমন অবস্থায় সাংসারিক দৈন্যতায় অনেকে কলেজ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছেন কিন্তু অধ্যক্ষ স্যারের সান্তনায় তারা কেউ যেতে পারেননি। তিনি বলেন, অধ্যক্ষ সব সময় কলেজের উন্নয়ন কাজে ব্যস্ত থাকতেন। শিক্ষক কর্মচারীদের আশা ছিল তাদের কলেজটি অগ্রাধীকার ভিক্তিতে এমপিওভুক্ত হবে। কিন্তু কিছুদিন আগে শুধুমাত্র কারিগরি শাখা এমপিওূক্ত হয়েছে। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ সাধারন শাখাও এমপিওভুক্তকরনে রিভিউ করেছেন। তারা আশা করছেন ভাল ফলাফল হবে। এমন অবস্থায় সকলকে কাঁদিয়ে কলেজের জন্য কাজ করা প্রধান মানুষটি চলে গেলেন। এখন ভাগ্যে কি আছে জানিনা।
স্ত্রী স্কুল শিক্ষক মোমেনা বেগম জানান, তার স্বামী ভালো বেতনের চাকুরী ছেড়ে গ্রামে এসে কলেজের দায়িত্ব নিয়েছেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই বিগত ১৮ বছর বিনা বেতনে চাকুরী করেছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারে শত কষ্টের মধ্যেও তিনি শুধু সান্তনা দিয়েছেন একদিন কলেজটি এমপিওভুক্ত হবে। সেদিন আর কারও অভাব থাকবে না। আজ কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থী বেড়েছে, বেড়ার ঘর থেকে নতুন ভবন হয়েছে। কারিগরি আংশিক শাখার এমপিওভুক্তও হয়েছে। কলেজের সাধারন শাখাও এমপিওর রিভিউ আবেদন করেছেন। আবেদন মঞ্জুর হলে সকলেরই একদিন বেতন পাবেন। কিন্তু তার সন্তানেরা কি পাবে, বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কলেজটির পরিচালনা পর্ষদের বিদ্যোৎসাহী সদস্য গোলাম রব্বানী জানান,অধ্যক্ষ রেজাউল করিম ছাত্রজীবনে বেশ মেধাবী ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাষ্টার্স শেষ করে তিনি গ্রামীন ব্যাংকের উচ্চ পদে লোভনীয় বেতনে চাকুরী করতেন। কিন্তু এলাকাবাসীর যখন কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে শুরু করে তখন এলাকার প্রয়োজনে চাকুরী ছেড়ে বাড়ি এসে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। তিনি বলেন, কলেজে কোন ছাত্র বেতন নেই। ফলে কলেজ থেকে কোন টাকা পেতেন না। ফলে অত্যান্ত মানবেতর জীবন যাপন তাদের। বেতন আসলে একদিন এ দৈন্যতা কেটে যাবে। এ আশা পূরণ হওয়ার আগেই বিনা বেতনে ১৮ বছর কষ্ট করে তিনি মারা গেলেন। তিনি আরও বলেন,অধ্যক্ষ রেজাউল করিম মনে প্রানে একজন সামাজিক মানুষ ছিলেন। শুধু কলেজ নয়,এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, এতিমখানা,ঈদগাহ নির্মানসহ সকল উন্নয়নমুলক কাজে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এলাকাবাসীকে সংগঠিত করেছেন। ফলে অধ্যক্ষের অসময়ে চলে যাওয়া এলাকার সব শ্রেনীর মানুষকে কষ্ট দিয়েছে।
বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামের বদিউজ্জামান জানান, তাদের পাশাপাশি ৩-৪ গ্রামের মাঝখানে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কলেজে অধ্যক্ষ রেজাউল করিম কলেজের জন্য ব্যাপক কষ্ট করেছেন। তিনি মনে প্রানে একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ ছিলেন। কলেজটি ইতোমধ্যে দাঁড় করিয়েছেন। অভাবের মধ্যে নিজের ২ মেয়ে ১ ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় মেয়ে তাহেরা তহমিনা মৌ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাষ্টার্স শেষ করেছেন। ছেলে মওদুদ রেজা মুন এম এম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাষ্টার্স শেষ করেছেন। আর ছোট মেয়ে রেজোয়ানা মাহাফুজা মৌসুমী এম এম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এ বছর মাষ্টার্সের ফল প্রত্যাশী। এতে বোঝা যায় তিনি শুধু কলেজে নয় নিজের পরিবারেও শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। সন্তানদের এখনও কারও চাকুরী হয়নি।
কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মধুসুদন সাহা জানান, এমপিওভুক্ত না হলে কলেজ থেকে কোন সুযোগ সুবিধা পাবেন না। তবে কলেজের একটি শাখা এমপিওভুক্ত হয়েছে। মানবিক শাখা এমপিওর জন্য রিভিউ করেছেন। এটা মঞ্জুর হলে অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের পরিবারও সুযোগ পাবেন।