ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) এর বাজারে নৈরাজ্য চলছেই। ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের জন্য ভোক্তাদের গুণতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি ৩০০-৩৫০ টাকা পর্যন্ত। সেই হিসেবে ১২ কেজির দু’টি সিলিন্ডার প্রয়োজন এমন পরিবারে মাসে শুধু এ খাতেই খরচ বেড়েছে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরাসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ভোক্তা পর্যায় ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। রাজধানীতে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ টাকায়। যেখানে গত জানুয়ারি মাসে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার ছিল ১২শ’ ৩২ টাকা। চলতি মাসের ২ তারিখে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ১২ কেজির একটি গ্যাস সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু নির্ধারিত মূল্যে কোথাও গ্যাস বিক্রি হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাতিরপুল বাজারের ত্রি-রত্ন এন্টার প্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমীর হোসেন জানান: সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সরকার তো আর গ্যাস দেয় না। ডিলারদের কাছ থেকে আমাদের গ্যাস নিতে হচ্ছে কোম্পানি ভেদে ১৫৫০ থেকে ১৬২০ টাকা পর্যন্ত। এরপর আমাদের দোকান খরচ আছে, সার্ভিস চার্জ আছে। সব মিলিয়ে ১৪৯৮ টাকায় একটি সিলিন্ডার বিক্রি করলে ১৫০ টাকা পর্যন্ত লোকসান হবে। তাহলে এতদিন বিইআরসি’র নির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি সম্ভব হলো কিভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন: কখনোই সরকার নির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি হয়নি। বাজার ১০০-১৫০ টাকা বেশি ছিল সব সময়। কিন্তু এখন দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এটা চোখে পড়ছে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে আসছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব জানতে চাওয়া হলে তেজগাঁওয়ের রেল গেইট এলাকার বাসিন্দা মঈনুল ইসলাম জানান: ভোগ্য পণ্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে সেটা সহনীয় মাত্র ছাড়িয়েছে অনেকে আগেই। দিন ঘুরলেই বাজারে জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। নতুন করে যোগ হয়েছে গ্যাস। নতুন বাড়ি হওয়ায় তার ভাড়া বাসায় এলপিজি গ্যাসেই রান্না-বান্না চলে। পাঁচজনের পরিবারে মাসে দু’টো ১২ কেজির সিলিন্ডার লাগে। সে হিসেবে শুধু গ্যাস বাবদই মাসে খরচ বেড়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান হোটেলের স্বত্বাধিকারী সালেহ মোহাম্মদ জানান: নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তার হোটেল ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ৩৫ কেজি সিলিন্ডারের গ্যাস তার হোটেলে দিন ১ থেকে ২টা প্রয়োজন হয়। কিছুদিন আগেও সেগুলো ৩৯০০ টাকায় পেলেও এখন কিনতে হচ্ছে ৪৬০০ টাকায়। যদিও ৩৫ কেজি সিলিন্ডারের জন্য বিইআরসি নির্ধারিত মূল্য ৪৩৭০ টাকা। ভোক্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাহলে আপনারা কেন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ করছেন না? তাদের দাবি: নির্দিষ্ট এলাকার গ্যাস সাপ্লায়ার নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি। অভিযোগ করে হয়তো সাময়িক প্রতিকার পাওয়া গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তো তাদের কাছ থেকেই গ্যাস নিতে হবে। তাই তাদের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চান না তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন: দেশে ২০-২২টি কোম্পানি বাজারে এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু ডলার সঙ্কটের কারণে অধিকাংশ কোম্পনির গ্যাস বাজারে আছে মাত্র ৪ থেকে ৫টি কোম্পানি। সরবরাহ সঙ্কটকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন তারা। মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারের গ্যাস ব্যবসায়ী জাফর আহম্মেদ জানালেন: ডিলারদের কাছ থেকে গ্যাস নিতে রীতিমতো দেনদরবার করতে হচ্ছে। আগে যেখানে গ্যাসের গাড়ি এসে গ্যাস দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো এখন সেখানে ফোন দিলেও ফোন ধরে না। ডিলারের অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। তারপর হয়তে ১০টা চাইলে ৪টা দেয়। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ডিলারদের ঘরেও গ্যাস নাই। ২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার এলপিজি গ্যাসের মূল্য বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিইআরসি। সেখানে সাড়ে পাঁচ কেজির সিলিন্ডার ৬৮৭ টাকা, ১২ কেজির এলপিজির দাম এক হাজার ৪৯৮ ও ১৫ কেজির এলপিজির দাম এক হাজার ৮৭৩ টাকা। ১৬ কেজির সিলিন্ডার এক হাজার ৯৯৮ টাকা, ১৮ কেজির দাম দুই ২৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া, ২০ কেজি এলপিজি দুই হাজার ৪৯৭, ২২ কেজির দাম দুই হাজার ৭৪৭, ২৫ কেজির দাম তিন হাজার ১২১, ৩০ কেজির দাম তিন হাজার ৭৪৫, ৩৩ কেজির দাম চার হাজার ১২৪, ৩৫ কেজির সিলিন্ডার চার হাজার ৩৭০ ও ৪৫ কেজির দাম পাঁচ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়।