রাজধানীর পুরান ঢাকায় নামীদামী ব্র্যান্ডের লোগো নকল করে প্রসাধনী তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে বহু বছর ধরেই। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই অবৈধ ব্যবসাকে যেন ঐতিহ্য হিসেবেই নিয়েছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। রূপচর্চায় বিদেশি নামীদামী ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর চাহিদা বেশ। এসব নামী ব্র্যান্ডের মোড়ক ব্যবহার করে ভেজাল প্রসাধনী তৈরি হয় কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায়। পরে সেগুলো চকবাজারের গুদামে পুরে রাখা হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর নামী বিপণি-বিতান, সুপার-শপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শহর ও মফস্বলের দোকানে। ২০২১ সালে ভেজাল প্রসাধনী পণ্যের বিরুদ্ধে ২৫০৯টি অভিযান পরিচালনা করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাব। অভিযান শেষে মামলা হয় ১৩ হাজার ৫৭টি। অভিযানে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল কোর্ট) ৪৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৪ টাকা জরিমানা আদায় করে। অভিযান শেষে ৯৮২ জনকে সরাসরি জেলহাজতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত র্যাব ১৩১টি অভিযান চালায়। মামলা দায়ের হয় ৫০৭টি। জরিমানা করা হয় তিন কোটি পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। কারাগারে পাঠানো হয় ৪৪ জনকে। এসব ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্য ও ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে অথবা সচেতনতার কথা বলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী দাপট। প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা, ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন আসল পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এই ভেজাল প্রসাধনী তৈরির চক্র মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধও নকল করে বিক্রি করছে। এই চক্রের রয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক। এসব নকল বা ভেজাল পণ্য কিনে মানুষের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কোম্পানির নকল পণ্য বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। শপিং মল, ফুটপাত এবং ছোটখাটো সব বাজারে এসব নকল পণ্য বিক্রি হচ্ছে সস্তা দামে। এসব নকল প্রসাধনীতে বিভিন্ন কোম্পানির নকল লোগো, বারকোড এবং মনোগ্রাম নিখুঁতভাবে তৈরি করে বসিয়ে দেয়া হয়। ফলে সাধারণ ক্রেতার পক্ষে আসল নকল যাচাই করা অনেক কঠিন হয়ে পরে। এতে শুধু জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রসাধনী সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে তার ১৫% আসে বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে, ১৫% আসে দেশিয় প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে। আর বাকী ৭০% প্রসাধনীই অবৈধভাবে বিভিন্ন গোপন কারখানায় তৈরি করা হয়। বাজারে একটি ৫০০ এমএল জনসন বেবি লোশনের দাম প্রায় ৮৫০ টাকা। আমদানি হয়ে দেশে আসতেই এর দাম দাঁড়ায় প্রায় ৭২০ টাকা। পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ৭৮০ টাকা। কিন্তু জনসন বেবি’র লোগো বসিয়ে একটি নকল ৫০০ এমএল লোশন তৈরিতে ব্যয় হয় মাত্র ১৫০-১৬০ টাকা। এসব ভেজাল পণ্য ব্যবহারের কারণে মানুষের অকালে চুল পরে যাওয়া, অল্পবয়সে বার্ধক্য চলে আসা, চামড়ায় ক্যান্সারের মত বড় ব্যাধি হওয়া সহ শরীরের অভ্যন্তরে ফুসফুস, হৃদপি-, কিডনি পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি অনেকেই মারাত্মক এলার্জেটিক রোগে আক্রান্ত হন যার ফলে অকালে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী যদি এমন মারাত্মকভাবে ভেজালে ভরা থাকে সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে হুমকিস্বরূপ। আর নকল পণ্য বন্ধে সরকারের ওপর শুধু দায়িত্ব দিলে হবে না। বড় শিল্পণ্ডপ্রতিষ্ঠানের উচিত নকল প্রতিরোধে নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো ও নিজস্ব টিম তৈরি করা। নকল ও ভেজাল পণ্য রোধ করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। সরকারকে এই ভেজাল ও নকল প্রসাধনী রোধ করতে আলাদা টাস্কফোর্স তৈরি করতে হবে, আর পাশাপাশি বিদেশী পণ্যের আমদানির উপর শুল্কহার কমিয়ে দিলেও হয়তো এই নকল প্রসাধনী তৈরি কিছুটা বন্ধ হবে।