আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে প্রাণহানি সহ ক্ষয়-ক্ষতি। বজ্রপাতে দুর্ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। রৌদ্রউজ্জ্বল বৃষ্টিহীন পরিবেশে বজ্রপাত ঘটছে। তবে বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মেঘলা আকাশ, বিদ্যুৎ চমকানি, গগণভেদি আওয়াজ আর ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বজ্রপাতে সৃষ্টি। এপ্রিল ও মে এই দুই মাসে বজ্রপাতের সংখ্যা বেশি থাকে। আর এ দুর্যোগ অক্টোবর মাস পর্যন্ত থাকে। এক দশক আগে বছরে বজ্রপাতে দুই চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। আর এখন বজ্রপাত মহামারি আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছরে সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে। যা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে সাধারন মানুষ থেকে সংশিøেষ্টর ভাবনার শেষ নেই। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টোর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম (এসএসটিএফ) ০৪ মে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছেন। এতে জানানো হয়, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪০ জন মারা গেছেন। আর ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছেন ২৭৪ জন। এরমধ্যে ২৩৯ জন পুরুষ আর ৩৫ জন নারী। শিশু রয়েছে ১২ জন। জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসাবে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত হয়ে পড়েছে। বর্ষাকাল শুরু থেকে বজ্রপাত বেশি হয়। আর বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া, গরম ও শীতল বাতাস পরস্পরের সংস্পর্শে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিতে চার্জযুক্ত হয়ে বিদ্যুৎ চমকায় এবং কোনো কোনো সময় বজ্রপাত হয়। যা উঁচুস্থানে আছড়ে পড়ে। আর তালগাছ সবচেয়ে উঁচু হওয়ায় সেখানেই বজ্রপাত হয়। এতে করে প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়। জনমনে প্রচলিত আছে, আগে বজ্রপাত হলে তা তালগাছ বা অন্য কোনো বড় গাছের উপর পড়তো। বজ্রপাত এক ধরণের বিদ্যুৎ রশ্মি। তাই বজ্রপাতের ওই রশ্মি গাছ হয়ে তা মাটিতে চলে যেত। এতে মানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। কিন্তু গ্রামে এখন আর আগের মত তালগাছ দেখা যায় না। তেমনি বড় আকারের গাছও এখন আর তেমন নেই। দেশের প্রায় সর্বত্রই তালগাছসহ বড় গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। দেশব্যাপী বনায়ণ হলেও তা আকারের দিক থেকে বড় হয়ে উঠেনি। মূলত এ কারণে বজ্রপাতে অনাকাঙ্কিত মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া বজ্রপাতের আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাই এ দুর্যোগ থেকে সাধারণ মানুষ যেন রেহাই পায় সেজন্য দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রাকৃতিক বিরূপ প্রভাবে বজ্রপাত হচ্ছে, তারপরও মানুষ থেমে নেই। কি ভাবে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ অনেকটাই কার্যকর। বিশেষজ্ঞারা অভিমত, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারন, তালগাছের পুরু বাকলে কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক। তালগাছের পাশাপাশি নারকেলগাছ, সুপারিগাছের মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরী। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায় প্রকৃতি। তাই প্রকৃতির সহায়তা নিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মার্চ ও এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হয়। উপকূলীয় এলাকায় এর মাত্রা কয়েক গুণ বেশি। বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশে। সারা পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যায় তার এক-চতুর্থাংশ মারা যায় এ দেশে। বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সেই সাথে গবাদিপশুও মারা যাচ্ছে ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অসংখ্য গাছপালা। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, বজ্রপাত কখন কোথায় পড়বে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুর্যোগ প্রবণ বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই বজ্রঝুঁকিতে রয়েছে। বজ্রপাত আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো, খোলামাঠ, রাস্তার পাশে এমনকি বিল, হাওড়-বাওড় ও বিস্তির্ণ ফসলের মাঠে উঁচু তালগাছ লাগাতে হবে। তাল, নারকেল, সুপারি প্রভৃতি উঁচু গাছ লাগানো যেতে পারে। এর মধ্যে বজ্রপাত নিরোধ হিসাবে তালগাছ উল্লেখযোগ্য। এ গাছই বজ্রপাত শোষক হিসাবে কাজ করবে। গ্রাম অঞ্চলে মাঠে কৃষক ও খেটে খাওয়া শ্রমজীবি মানুষ আকস্মিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে রেহাই পাবে। আগে উঁচু বিল্ডিং গুলোতে বজ্রপাত শোষক ‘থান্ডার এরেস্টার’ লাগানো হতো। এখন শহর ও গ্রাম অঞ্চলের উঁচু বিল্ডিং বানানোর সময় আগেই থান্ডার এরেস্টার লাগানোর পরিকল্পনা রাখতে হবে। তবে বজ্রপাত থেকে কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকবে। কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে বজ্রপাতের ঘটনা স্বাভাবিক। ঘণকাল মেঘের চারিপাশ ধারায় নামা বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত জনমনে উদ্বেকও তৈরি করে। বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেঘলা আকাশ আর বিদ্যুৎ চমকানো থেকে বজ্রপাত ঘটতে থাকে। সব বজ্রপাত প্রকৃতির বুকে আঘাত হানে না। অধিকাংশ মহাকাশে বিলিন হয়ে যায়। আর কিছু কিছু বজ্রপাত প্রকৃতির বুকে আঘাত হানে। বজ্রপাত যেহেতু উঁচু জায়গা আঘাত হানে, সে জন্য খোলামাঠ বা বসতবাড়ির পাশে উঁচু গাছ হিসাবে তালগাছ বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে সব থেকে কার্যকর। যেহেতু উঁচু স্থানে বজ্রপাত হয় সে কারণে তালগাছ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এ গাছ দীর্ঘজীবী। প্রায় একশত বছর বাঁচে। এটা শুধু বজ্রপাত প্রতিহত নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তালগাছের প্রয়োজন রয়েছে। কালবৈশাখী-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা-জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প অগ্নিকান্ডের সঙ্গে নতুন দুর্যোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। বিষয়টি সরকারকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনা করেছে। বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মোবাইল টাওয়ার গুলোতে আর্থিং এর ব্যবস্থা সংযুক্ত করে বজ্র নিরোধক দন্ড হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বজ্রপাত মোকাবেলায় দালান কোঠায় বজ্র নিরোধক দন্ড লাগানো বাধ্যতামূলক করতে গণপূর্ত মন্ত্রাণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের ১৫টি দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণে বজ্রপাত নিরোধক দন্ড স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে তালবীজ রোপণের পাশাপাশি জন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা হলে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে প্রাণহানি সহ ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।