আমাদের দেশে গত কয়েক দশকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, শিক্ষার হারও বেড়েছে এবং একইসঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্বিবিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাধারার সঙ্গে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারাও প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি সাধনে এগিয়ে এসেছে। দেশে শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ অনেকটা হয়েছে বটে, তবে গুণগত উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশের হার বৃদ্ধি ও অধিক জিপিএ প্রাপ্তি নিয়ে বেশ গর্ব ও স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি শতভাগ পাশ বা শিক্ষার পরিবর্তে মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করত, তাহলে তা দেশ, জাঁতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনত। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ এসব শিক্ষার্থীর একটি বিশাল অংশ যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে। শুধু তাই নয়, গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বৈশ্বিক মানদণ্ডে পিছিয়ে পড়ছে। অথচ শিক্ষা একটি দেশের উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যে দেশের শিক্ষার হার ও গুণগত মান যত বেশি, সেই দেশ তত বেশি অগ্রসর। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর গুণগত মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান উপায় হচ্ছে মানসম্মত বা মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য স্বচ্ছতার সঙ্গে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সব শিক্ষকের জন্য বুনিয়াদি ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্মরত শিক্ষকদের জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং একইসঙ্গে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে অবশ্যই যথোপযুক্ত বেতনভাতা দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা এবং পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। দেশে শিক্ষার নিচু স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। এটা গুণগত শিক্ষার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ও হুমকি। যদিও কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা অর্জনই প্রকৃত অর্থে গুণগত শিক্ষা। তাই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে সৃজনশীল ও প্রয়োগমুখী করে তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে যথাযথ অবকাঠামো ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দিয়েই সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। গুণগত শিক্ষা অর্জনে ও টেকসইকরণে, বৈষম্যহীন সমন্বিত শিক্ষা, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম, মানসম্মত ও পেশার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ শিক্ষক, প্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় এনে ধরে রাখা, সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি নির্মূল ও অপচয় রোধ এবং শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ। এসব শর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে গুণগত শিক্ষার মান। বাংলাদেশে শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ এশিয়ায় সর্বনিম্ন আর তার পাশাপাশি চলছে ব্যয়বহুল বেসরকারি শিক্ষা। ফলে শিক্ষার বৈষম্য বেড়েছে, কমেছে শিক্ষার মান। তাই শুধু শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে কাজ হবে না, শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকারি শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়তে হবে। শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং ছাত্রদের শিক্ষা উপকরণের পিছনে ব্যয় বাড়াতে হবে। তবে বেতনের স্বল্পতা আমাদের শিক্ষা খাতের মূল সমস্যা নয়। মূল সমস্যা খুব সম্ভবত সততা, নিষ্ঠা ও সুশিক্ষার অভাব।