প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বরিশালে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করেই বরিশাল কিংবা খুলনা নয়; দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাস যাবে সরাসরি ঢাকায়।
সিএনজি আকারে ভোলার গ্যাস তিতাসের আওতাধীন শিল্পণ্ডকারখানায় সরবরাহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছেন বরিশালের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ ও জনপ্রতিনিধিরা। প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কি হবে? এতোদিন জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনসহ সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আশ্বাস ছিলো বরিশাল হয়ে খুলনা যাবে ভোলার গ্যাস।
পদ্মা ও বেকুটিয়া সেতুর সুফল কাজে লাগাতে এটাই ছিলো অন্যতম প্রতিশ্রুতি। তাছাড়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল নগরীর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছিলেন, ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বরিশালে নিয়ে আসা হবে। শুধু গ্যাস নয় ভোলায় পাওয়ার প্লান্ট করে সেখান থেকে বিদ্যুত বরিশালে আনা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির সময় ভোলায় মাত্র একটি গ্যাসফিল্ড ছিলো। আজ সেখানে আরো দুটি গ্যাসফিল্ড।
ভোলায় সবমিলিয়ে প্রায় তিন টিসিএফ গ্যাস মজুদের কথা জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পাইপ লাইনে বরিশাল হয়ে খুলনা যাবে ভোলার গ্যাস। তবে তা হতে আরো বছর দুয়েক সময় লাগবে। কিন্তু একবার সিএনজি রূপান্তরিত শুরু হলে তা আর পাইপ লাইনে আসার গুরুত্ব থাকবে না বলে জানিয়েছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী। সূত্রমতে, গত ২১ মে রাজধানীর একটি হোটেলে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, যেসব এলাকায় গ্যাসের সমস্যা বেশি সেসব এলাকায় ভোলার গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এতে গ্রীডে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি সংকট দূর হবে।
সনাকের বরিশাল জেলার সাবেক সভাপতি প্রফেসর শাহ্ সাজেদা বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ কাঠ ও চড়া দামে এলপিজি ব্যবহার করে অনেকটাই ক্লান্ত। তাদের জ্বালানির প্রয়োজনে ক্রমেই বনাঞ্চল উজার হওয়ায় জলবায়ুর প্রভাব পরছে। সেখানে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন হঠাৎ করে ভোলার গ্যাস ঢাকায় নিয়ে যাওয়াটাকে বরিশালবাসীকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে।
বরিশালের রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, দেশে চরম গ্যাস সংকটের মধ্যে ভোলায় গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলন বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় সুখবর। দীর্ঘদিন ধরে বাপেক্স গ্যাসের অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করছে। তারা দেশে নতুন আরো একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে ভোলার ইলিশা গ্রামে। এতে আমাদের স্বপ্ন আরো বেড়েছে। তাই এতোদিন শুধু বরিশালে গ্যাসের দাবী ছিলো, এখন আমরা দক্ষিণাঞ্চলের জন্য গ্যাসের দাবী করার সক্ষমতা অর্জন করেছি। তিনি আরও বলেন, ভোলার ইলিশা গ্রামে তৃতীয় গ্যাসক্ষেত্র। ভোলার অপর দুটি গ্যাসক্ষেত্র হলো শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্র। এই তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে চাহিদার বেশি উৎপাদন ও সরবরাহ পাওয়া যাবে বলেও শুনেছি। তবে সমস্যা হচ্ছে আমাদের বরিশালের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত খুবই জরুরি। তাই আমাদের ন্যায্য অধিকার ভোলার গ্যাস আগে বরিশালে আনার জন্য এখনই প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাজনৈতিক নেতাদের জোরালো দাবি তুলতে হবে।
বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, রাজনীতির বাহিরে আমাদের বরিশালের উন্নয়নের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম থাকা খুবই জরুরী। ভোলার গ্যাস বরিশালে আসার দাবিতে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরাসরি বৈঠক করা এখন খুবই জরুরী হয়ে পরেছে। কেননা একবার জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে আগামী দশ বছরেও বরিশালে গ্যাস আসবেনা। তাছাড়া সিএনজি নয়, পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাসের সুবিধা চায় বরিশালবাসী।
একই দাবী বরিশালের চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু, বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর হোসেনসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বাসদসহ জেলার প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের।
অতীতে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন উল আহসান পাইপ লাইনে গ্যাস আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তবে এখনো আশাবাদী হয়ে বিভাগীয় কমিশনার আমিন উল আহসান বলেন, পাইপলাইনে আনার যে পরিকল্পনাটি ছিলো তা প্রচন্ড ব্যয় বহুল হওয়ার কারণে সরকারকে বিকল্প চিন্তা করতে হচ্ছে। সিএনজি প্রক্রিয়ায় ঢাকায় নিয়ে যেতে হলেও বরিশালের ওপর দিয়েই যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি যতোদূর জানি ভোলার গ্যাস বরিশাল হয়েই যাবে। সরকারের পরিকল্পনায় এখনো এটাই অগ্রাধিকারে আছে।
অপরদিকে বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম বাপেক্সের হয়ে কূপটি খনন করেছে। গত মার্চে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মালেরহাট সংলগ্ন এলাকায় এই খননকাজ শুরু করা হয়। ৩ হাজার ৪৭৫ মিটার গভীর পর্যন্ত খননকাজ শেষ হয়েছে গত ১৪ এপ্রিল। এই কূপের তিনস্তরে ২০০ বিলিয়ন ঘণফুট গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশে এই মুহুর্তে গ্যাস সংকট চরমে। যার প্রভাব পরছে শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ এবং গৃহস্থালি খাতে। গ্যাস সংকটের কারণে একদিকে যেমন ভুগছেন সাধারণ মানুষ, অপরদিকে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানার উৎপাদন। এনিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন বরিশালবাসী বলছেন, ঢাকাবাসী প্রচন্ড কষ্টে আছে আমরা মানছি। গ্যাস-পানি ও বিদ্যুৎ সংকটে তাদের দফারফা হবার জোগার তাও সত্য। সেখানে চাহিদার তুলনায় লোকসংখ্যা এখন তিন থেকে চার গুণ বেশি। এ সংখ্যা দিনকে দিন আরো বৃদ্ধি পাবে যদি না বিভাগীয় শহরগুলোকে বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আর সেজন্য বরিশাল বিভাগে গ্যাসের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
ি
সএনজি বা এলপিজি পদ্ধতি ব্যবহারের আগেই পাইপ লাইনে বরিশালে গ্যাস দেওয়ার দাবী জানিয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাইপ লাইন ব্যয়বহুল বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বিলম্ব হবে, এটা খুব সম্ভব প্রধানমন্ত্রীও চাইবেন না। বরিশালে যেহেতু কোনো সিএনজি বা এলপিজি রূপান্তরিত কারখানা নেই, তাই আমাদের পাইপ লাইনেই গ্যাস পেতে হবে। যেটা দুইবছর পরে দেবেন বলছেন, সেটা এখনই কেন অসম্ভব হবে বলে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। তিনি বরিশালে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন।
সচেতন বরিশালবাসীর দাবী, ভোলা থেকে পাইপ লাইনে বরিশালে গ্যাস এনে তারপর তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি সরকারের পরিবহন ব্যয়ও কমে যাবে। তারা আরও বলেন, যে সরকার নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কাজ করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে তার জন্য ভোলা থেকে পাইপ লাইনে বরিশালে গ্যাস আনা মোটেও কঠিন কিছু নয়।
অপরদিকে বাংলাদেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতামতও বরিশালবাসীর পক্ষে। তারা সিএনজি আকারে গ্যাস সরবরাহকে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে দেখছেন। এজন্য তারা টেকসই সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। একইসাথে নিরাপত্তাগত ঝুঁকি এড়াতে সর্বোচ্চ নজরদারির তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, এটা যৌক্তিক যে এখন কিছু নেই। তাই আমি যতোটুকু পারি, সিএনজি নিয়ে আসলাম কয়েকটা কারখানাতে। কিন্তু এটাতো স্থায়ী সমাধান দেবে না। কারণ সিএনজি দিয়ে অতি অল্প পরিমাণ গ্যাস আনা যাবে। আমাদের যেটা দরকার, সেটি হচ্ছে একটা পাইপ লাইন। ওই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘১ দশমিক ৭ টিসিএফ গ্যাস যদি পাওয়া যায়, তাহলে আমি বলবো যে সেখানে বড়ধরনের মজুদ রয়েছে। সেক্ষেত্রে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনাটা অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে। এ ছাড়া ২৫ মিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস ট্রাকে পরিবহন করাটা কোনো কৌতুক নয়, এটা বাস্তবে অনেক কঠিন।