ভালো নেই শেরপুরের পাহাড়ের মানুষ। ক্ষুুধার জ্বালায় বেপরোয়া হয়ে পড়েছে বন্য হাতির দল। এই হাতি দেখতে প্রায় প্রতিদিন উৎসুখ জনতার ভিড় করছে পাহাড়ী এলাকায়। চিল্লা চিল্লি, লাইট ব্যবহার, ধাওয়া দেওয়ায় কারণে বন্যহাতি ও স্থানীয় মানুষজনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অতিষ্ঠ হয়ে এক অসহনীয় জীবন যাপন করছে পাহাড়ী এলাকার মানুষজন। বৃহস্পতিবার ৮ জুন এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বন্য হাতির দল শেরপুরের নালিতাবাড়ী গহীন পাহাড়ী এলাকা কালাপানি নামক স্থানে অবস্থান করছে।
প্রাপ্ত সূত্রে, হাতির খাদ্যের অভাব, আবাস স্থলের সঙ্কট, সবমিলিয়ে প্রতিকুল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকা দুরুহ হয়ে পড়েছে এই হাতিগুলোর। খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে গিয়ে হাতিগুলো নষ্ট করছে ক্ষেতের ফসল, ধ্বংস করছে বাড়িঘর, সাবাড় করছে ঘরের খাবার, ফলজ বাগান। মারছে মানুষ, মারা পড়ছে নিজেরাও। ফলে শেরপুরের নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী উপজেলাসহ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া উপজেলার গারো পাহাড়ের হাতি ও মানুষ উভয়েই পড়েছে হুমকির মুখে।
স্থানীয়দের মতে, শেরপুরের গারো পাহাড় এক সময়ে ঘন বনাঞ্চল ছিল। এ বনাঞ্চলেই দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে হাতিগুলোর স্থায়ী বাস। ভারত সীমানা জুড়ে কাঁটাতারের বেড়ার কারণে হাতিরা ফিরতে পারছে না আপন আবাস স্থলে। নদীপথে অনেক সময় সীমানা অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করলেও, সেখানকার লোকজন আবার ফেরৎ পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ সীমানায়। বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড় কেটে পাথর, চিনামাটি উত্তোলন করে পাহাড়ি ঝর্ণার উৎসমুখ ও হাতি চলাচলের রাস্তা বন্ধ হওয়ায় এখানেও হাতি বসবাসের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে। খাবারের সন্ধানে বাধ্য হয়ে হাতিগুলো প্রতিদিন চলে আসছে লোকালয়ে। প্রথমে এর সংখ্যা ছিল ৩০/৩৫ টির মত। বর্তমানে রয়েছে শতাধিক হাতি। এরা ৩/৪ টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে বিচরণ করে থাকে। হাতিগুলো পাহাড় থেকে যখনই সমতলে নামছে, তখনই শুরু হচ্ছে মানুষ হাতির যুদ্ধ।
গারোপাহাড়ের বাসিন্দারা জানায়, দিন দিন হাতির অত্যাচার বাড়ছেই। আগে হাতি গুলো রাতের আঁধারে ফসলের মাঠে নামতো, ফসল খেযে চলে যেতো। এখন হাতিগুলো ক্ষুধার যন্ত্রণায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাত নয়, দিনের বেলায়ই লোকালয়ে নেমে আসে। ধ্বংস যজ্ঞ চালায় ফসলের মাঠে, বাড়ি ঘরে। দুই দশকে হাতির আক্রমণে মারা গেছে ৬৪ জন মানুষ। পঙ্গু হয়েছ একশ’ জনেরও উপরে। পাহাড়ের গর্তে পড়ে, বার্ধক্যজনিত, অসুস্থতা ও মানুষের পাতা ফাঁদে মারা গেছে ৩৫ টির বেশি হাতি। হাতির তান্ডবে অনেক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষী পরিবার বেকার ও দিন মজুর হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, আম কাঁঠাল সহ বিভিন্ন ফল, গোলার ধান সহ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। শুধু শেরপুরের তিন উপজেলার ৩০ গ্রামের অন্তত: ৫০ হাজার মানুষের জীবন কাটে হাতি আতঙ্কে।
নালিতাবাড়ী সীমান্তের বুরুঙ্গা কালাপানি এলাকার এন্ডারসন সাংমা, লুইস নেংমিজা জানান, আগে মশাল জা¦লিযে, হৈ-হুল্ােড় করে হাতি তাড়ানো যেতো। এখন হাতি কোনটাই পড়োয়া করে না। উল্টো মানুষকেই ধাওয়া করে হাতি। পাহাড়ে হাতি গুলো খাদ্য ও পানিয় জলের চরম সঙ্কটে পড়েছে। তাই তৃষ্ণা মিটাতে হাতিগুলো পাহাড়ি কোন জলাশয় কিংবা নদীতে নেমে পড়ছে।
বন বিভাগ জানায়, গত দুই দশকে গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের সহাবস্থান তৈরিতে সরকারীভাবে কাঁটাযুক্ত গাছ ,কলাগাছ রোপণ, জগ ল্ইাট, জেনারেটর, কেরেসিন, হ্যান্ড মাইক সরবরাহ, হাতি তাড়াতে মৌমাছি পালন, সোলার ফেন্সিং স্থাপন, সভা-সেমিনার, ইলিফেন্ট রেসপন্স টিম গঠন সহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। নেওয়া হয় হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে তিন লক্ষ টাকা, আহত হলে এক লক্ষ টাকা এবং ফসল বাড়িঘর ক্ষতি হলে ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা। কিন্তু কোন কাজেরই প্রত্যাশিত ফল মিলেনি। ফলে ভালো নেই গারো পাহাড়ে মানুষ এবং হাতি। গারো পাহাড়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া, নয়াবিল, পোড়াগাও ইউনিয়নের পানিহাটা, তাড়ানি, নাকুগাঁও, দাওধারা কাটাবাড়ি, বারোমারি, বুরুঙ্গা, কালাপানি, মধুটিলা, সমুচ্চুড়া, ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ও কাংশা ইউনিয়নের হলদিগ্রাম, গোমড়া, সন্ধ্যাকুড়া, রাংটিয়া, নওকুচি, গান্ধিগাঁও, হালচাটি, গজনী, বাঁকাকুড়া, গুরুচরণ দুধনই, জুকাকুড়া, পানবর ও তাওয়াকুচা এবং শ্রীবরদি উপজেলার রাণীশিমুল ও সিঙ্গাবরুণা ইউনিযনের হাড়িয়াকোণা, বাবলাকোণা, চান্দাপাড়া, মেঘদল, চুকচুকি, কর্ণঝোরা, ঝুলগাঁও, বালিজুড়ি, হাতিবর, মালাকোচা, খ্রিষ্টানপাড়া, রাঙ্গাজান, খাড়ামোড়া ও হালুয়াঘাটের অনেক গ্রামে পর্যায়ক্রমে হাতিগুলো তান্ডব চালায়।
শেরপুর জেলা রেসস্পন্স টিমের সভাপতি উকিল উদ্দিন বলেন, আমাদের সীমান্তবতী উপজেলা গুলিতে দুইশতাধিক সদস্য রয়েছে। তারা প্রতিয়িত রাত দিন হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে। মানুষকে মাইকিং করে সচেতন করছে এবং সহযোগিতা করছে।
এদিকে সীমান্তবর্তী শেরপুরের একটি উপজেলা নালিতাবাড়ী উপজেলা নিবর্্াহী কর্মকর্তা খ্রিষ্টফার হিমেল রিসিল বলেন, জানা মতে বন বিভাগ থেকে হাতির অভয় আশ্রম তৈরির জন্য একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এদিকে উৎসুখ জনতা হাতি এবং স্নানীয় মানুষদের বিরক্ত করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। একই সাথে হাতির দ্বার যারা ক্ষতির মুখে পড়েছে, ক্ষতি পূরন হিসাবে যারাই আবেদন করছে তারা ক্ষতি পূরন পাবে।
মধুটিলা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সব সময় হাতি গুলোকে কেউ যাতে বিরক্ত না করে, সে বিষয়ে সচেতন করি। কারণ হাতি দ্বারা যে কোনো প্রকারের জান মালের ক্ষতির সন্মুখিন হলে সরকার তাদের ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করে। তবে গারোপাহাড়ে হাতি মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
শেরপুর জেলা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার জানান, হাতি মানুষের সহবস্থান তৈরির জন্য ২৩ টি ইলিফেন্ট রেসপন্স টিম আবার সক্রিয় করা হচ্ছে। পাশাপশি হাতির অভয়াশ্রম তৈরির একটি প্রস্তাবনা বন বিভাগে পাঠানো হয়েছে।