নির্মাণশ্রমিকদের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই আসে। তার পরেও কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো অবহেলিতই থাকছে। দেশের নির্মাণশ্রমিকদের জীবন ঝুলছে যেন এক পচা সুতায়। এই দেশে একেবারেই মূল্যহীন হলো সাধারণ প্রান্তিক মানুষের জীবন। এর জন্য আইন প্রয়োগের অভাব ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অসচেতনতাই দায়ী। অনানুষ্ঠানিক খাতের অনানুষ্ঠানিক মানুষগুলোর অনেকে প্রায় প্রতিদিনই আনুষ্ঠানিকভাবেই মারা যাচ্ছেন। ঝুপঝাপ করে উঁচু সব ইমারত থেকে অনেকে পড়ে মারা যাচ্ছেন, অনেকেই মর্গে পড়ে থাকছেন স্রফে নম্বর বা সংখ্যা হয়ে। অনেক ভবনের মালিকও রয়েছে তারা চেনেন ও না নিহত শ্রমিককে। নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই উদাসীনতা যে কেবল ব্যক্তিমালিকানাধীন ইমারতের ক্ষেত্রেই ঘটছে, তা নয়। বিলসের গবেষণায় দেখা গেছে, নির্মাণকাজে ভালো সিঁড়ির অভাব ও সিঁড়িতে পর্যাপ্ত আলোর অভাব, এলোমেলোভাবে রড, বালু ও ইট রাখা, কর্মক্ষেত্রে জাল না থাকা অথবা নাজুক জালের ব্যবহার, কপিকলের ব্যবস্থা না থাকা, হেলমেট, গ্লাভসের ব্যবস্থা না করা, খালি পায়ে কাজ করা, অসাবধানতা ও অসচেতনভাবে আবদ্ধ স্থানে প্রবেশ, প্রচণ্ড রোদে কাজ করা, ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, বিশ্রাম কম; দুর্বল মাচা, দেয়াল বা মাটিচাপা পড়া, ঝুলন্ত অবস্থায় কাজের সময় বেল্ট ব্যবহার না করা, ভালো জুতা বা বুট ব্যবহার না করা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকে তো নিরাপত্তা সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও সেগুলো না পরেই কাজ করছে। শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া নিয়োগকারী কাউকে কাজে নিয়োগ করতে পারবেন না। তাই আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকা খুবই জরুরি। কেননা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকেরা। ফলে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যানে তথ্য অনুযায়ী গত দুই দশকে এই খাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ৯১০ জন শ্রমিক। তাই শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘শিল্প স্বাস্থ্য সেফটি কমিটি’ গঠন করা জরুরি। যদিও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি কমিটি থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এই কমিটি নেই। ফলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষকে চাপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর পাশাপাশি ভবন নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী কাজের সময় শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কারণ নির্মাণ খাতে প্রতিবছর অনেক শ্রমিক আহত ও নিহত হন। তাই আমরা চাই কর্মস্থল নিরাপদ হোক। একটিও প্রাণ আর অকালে না ঝরুক।