খুলনার পাইকগাছায় মালিক-শ্রমিক নার্সারী গুলোতে চারা উৎপাদন ও জোড়কলম তৈরীতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। তীব্র তাপদাহের মধ্যে শ্রমিকরা মাথার উপর ছাতা দিয়ে কাজ করছে। মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রুত ফলন, রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। গাছের চারা তৈরীর পদ্ধতির নাম কলম। এ কলম তৈরীতে রয়েছে নানা নাম ও পদ্ধতি। যেমন, গুটিকলম, শাখাকলম (কাটিং), চোখকলম বা বাডিং। তবে কলম তৈরীতে গ্রাফটিং বা জোড়কলম, কাটিং বা উপজোড় কলম উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ যৌনকোষ বা তার অঙ্গজকোষ থেকে নতুন স্বতন্ত্র গাছ সৃষ্টি করে তাকে বংশবিস্তার বলা হয়। যেমন যৌন বংশবিস্তার ও অযৌন বংশবিস্তার। গাছ রোপণের মূল উদ্দেশ্য হলো ভাল, উন্নতমান ও মাতৃগুণ সম্পন্ন ফল পাওয়া। এ কারণে ফল গাছ রোপণের ক্ষেত্রে যৌন পদ্ধতির তুলনায় অযৌন পদ্ধতির চারা/কলম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা/কলম রোপণ করলে মাতৃগুণ সম্পন্ন ফল পাওয়া যায়। গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে এবং গাছ ছোট হয় বিধায় অল্প জায়গায় অনেক গাছ লাগানো যায়। অযৌন বংশবিস্তার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ব্লেফট গ্রাফটিং বা ফাটল জোড়কলম একটি অন্যতম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একাধিক ফল গাছে কলম করা যায়। অন্যান্য জোড় কলমগুলোর তুলনায় ফাটল জোড়কলম পদ্ধতিতে কাটা স্থানের দুই পাশ দিয়ে জোড়া লাগে বিধায় জোড়াটি সবল হয় এবং সহজে জোড়া স্থানটি ভাঙ্গা সম্ভবনা থাকে না। তুলনা মূলক ভাবে এ পদ্ধতি অন্যান্য জোড়কলম পদ্ধতিগুলোর তুলনায় সহজ। সফলতার হার বেশি এবং খরচ ও কম পড়ে। এ কলম তৈরী করতে গ্রাফটিং চাকু, ব্লেড, সিকাচার, পলিথিন ক্যাপ, পলিথিন ফিতা, সুতলী, গাছের ডগা বা সায়ন এবং কলম তৈরীতে দক্ষ কারিগর বা মালির প্রয়োজন হয়। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত কলম করার উপযুক্ত সময়। কারণ এ সময় বাতাসের আদ্রতা ও গাছের কোষের কার্যকারিতা বেশি থাকে। তাড়াতাড়ি জোড়া লাগে এবং সফলতার হারও বেশি থাকে। উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে ছোট-বড় প্রায় ৫ শতাধিত নার্সারী গড়ে উঠেছে। যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যা রয়েছে গদাইপুর ইউনিয়নে। মৌসুম শুরুতে চারা তৈরীর জন্য নার্সারী মালিক ও কর্মচারীরা ব্যাস্ত হয়ে ওঠে। জোড়কলম তৈরী করতে গাছের ডালের সঙ্গে গাছের ডাল জোড়া লাগিয়ে জোড় কলম তৈরী করা হয়। তেজপাতার সঙ্গে কাবাবচিনি, আম সঙ্গে আম, ছবেদার সঙ্গে খিরখাজুর, আতা সঙ্গে দেশী আতা জোড় দিয়ে জোড়কলম তৈরী করা হয়। কাঁটা জাতীয় কুল সহ বিভিন্ন ফলের চারা চোখ বসিয়ে বাডিং কলম তৈরী করা হয় এবং ফুল জাতীয় গাছের ডাল কেঁটে সরাসরি মাটিতে পুতে কমল তৈরী করা হয়। জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন নার্সারীতে চলতি মৌসুমে আম, পেয়ারা, জামসহ বিভিন্ন ফলের ১০ লাখ ও কুলের প্রায় ১৫ লাখ কলম তৈরী হচ্ছে। নার্সারী মালিক হাবিবুর রহমান জানান, গত বছর তার নার্সারীতে উৎপাদিত চারা বিক্রি করতে না পারায় ক্ষেতে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ বছরও তিনি নার্সারীতে চারা উৎপাদনে ব্যাস্ত রয়েছে। সততা নার্সারীর মালিক অঞ্জনা রানী পাল জানান, তার নার্সারীতে বিভিন্ন জাতের কুলের প্রায় এক লাখ কলম তৈরী করছেন। শ্রমিকের অভাবে কলম তৈরী করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে কলম তৈরীর সময় পার হয়ে গেলে এ মৌসুমের আর কলম তৈরী করা যাবে না। সে কারণে কলম তৈরীতে অধিক পয়সা খরচ হচ্ছে। নার্সারীতে বিভিন্ন জাতের হাইব্রীড জাত কাটিমন আম, মাল্টা, পিয়ারা, সফেদা, জামরুল। তাছাড়া এসব কলমের মধ্যে থাই পেয়ারা, জামরুল, মালাটা, কদবেল, কমলালেবু, আমসহ বিভিন্ন জাতের কলম রয়েছে। উপজেলা নার্সারী মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অশোক কুমার পাল জানান, বিগত বছর চারা বিক্রি না হওয়ায় ক্ষেতে চারা শুকিয়ে নষ্ট হয়েছে। এতে নার্সারী মালিকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সে কারণে এবছর কলম কম হচ্ছে। তাছাড়া কলম তৈরীর শ্রমিক ঠিকমত না পাওয়ায় উচ্চ মূল্যে শ্রমিক নিয়ে কলম তৈরী করতে হচ্ছে। উপজেলায় তৈরী কলম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লা, রাজশাহী সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। তবে ঠিকমত বাজার দর না পাওয়ায় নার্সারী মালিকরা আশানারূপ ব্যবসা করতে পারছে না। নার্সারী ব্যবসায়ীরা জানান, চারা উৎপাদনে সরকারি ভাবে লোনের ব্যবস্থা করলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নার্সারী শিল্প গুররুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, পাইকগাছার নার্সারী শিল্প খুলনা জেলা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। নার্সারী ব্যবসায়ীরা চারা বিক্রি করার আশানারূপ বাজার ধরতে না পারায় তারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নার্সারী ব্যবসা করে মালিক, ব্যবসায়ীরা সাবলম্বী হচ্ছে। তেমনি নার্সারীতে নিয়জিত হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।