আয়বৈষম্য দিনকে দিন বেড়ে যাওয়ায় ধনীরা আরও বেশি মাত্রায় ধনী হচ্ছে, বিপরীতভাবে গরিবরা হচ্ছে আরও গরিব। পাঁচ দশক ধরে আমাদের অর্থনীতিতে এ কাজটি চলছে নির্দয়ভাবে। দু-একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যাবে। প্রথমে আমাদের মোট জনসংখ্যাকে সম্পদের মালিক হিসাবে ১০টি ভাগে ভাগ করা যাক। যেমন: প্রথম ১০ শতাংশ সবচেয়ে ধনী, এর পরের ১০ শতাংশ একটু কম সম্পদের মালিক এবং ক্রমানুসারে সর্বশেষ স্তরের ১০ শতাংশ সবচেয়ে গরিব। ১৯৭৩-৭৪ সালের সঙ্গে ২০২২ সালের তুলনা করলে আমাদের মোট সম্পদের ওপর একমাত্র প্রথম ১০ শতাংশের মালিকানাই বেড়েছে, বাকি নয়টি আয় স্তরের মানুষের সম্পদের মালিকানা কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের খানার আয় ও ব্যয় জরিপ থেকে উঠে এসেছে এ তথ্য। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ব্যাংক আমানতের হিসাবে কোটিপতি ও অতি-ধনীদের সংখ্যা দ্রুতই বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল নিম্ন আয় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে অনেকাংশেই পৌঁচচ্ছে না বললে হয়তো ভুল হবে না, আর তাই বাড়ছে বৈষম্য। গড়পড়তা সম্পদ বাড়লেও অতিধনী আর অতি-গরিবের ফারাক দুর্বিনীতভাবে বেড়ে চলেছে। আয়বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে থাইল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার সরকার আশির দশকের শুরুতে প্রান্তিক মালে গোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে থাইল্যান্ডে আয়বৈষম্য যখন ক্রমে বৃদ্ধি পাঁচ্ছিল, তখন তারা নীতি-কাঠামো সংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং নিশ্চিত করা হয় যেন সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে সুবিধাগুলো পৌঁছায়। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে তালিকা করে কর্মসূচির প্রতিটি ধাপে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। আয়বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে চাইলে ঢালাওভাবে টিসিবি বা প্রায় রুগ্ন রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে সম্পৃক্ত না করে ‘বাজার ব্যর্থতা’ কেন হয়, তা ভালোভাবে বুঝে এ হেন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে যৌক্তিকভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। একদিকে যেমন দরকার উচ্চবিত্ত শ্রেণির সম্পদ সংবর্ধনের লাগাম টানা, তেমনি প্রয়োজন নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থার পরিবর্তন কিংবা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। আয়করের আওতায় করযোগ্য সবাইকে আনতে হবে আর করনীতি হতে হবে বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে। এ ক্ষেত্রে কর খাত সম্প্রসারণ করে রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। আয়বৈষম্য কমাতে হলে গ্রামীণ অবকাঠামো ও কৃষি উন্নয়নে, বিশেষ করে গ্রামের রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, সেচব্যবস্থা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং পানির লবণাক্ততা নিরোধ প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনয়নের জন্য সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।