ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার একটি অজপাড়াগাঁ পারিয়াট গ্রাম। বর্তমানে এই গ্রামের শতাধিক পরিবার তালপাখা বা হাতপাখা তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংসার চলে তাদের। প্রায় শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে এ পেশা চলে আসছে তাদের। গরমের সময় পাখার অতিরিক্ত চাহিদা থাকায় পুরো বছর জুড়ে চলে পাখা তৈরির কাজ। প্রতিদিন সকাল থেকেই শুরু হয় ব্যস্ততা। যেখানে চোখ যায় সেখানেই দেখা যায় কেউ পাতা কেটে সাইজ করছে, কেউ বাঁশ থেকে শলা সংগ্রহ করছে, কেউবা সেলাই করছে আবার কেউ সুতা ও বাঁশের শলাতে রং করায় ব্যস্ত। মূলত শীতের সময় জেলা ও জেলার বাইরে থেকে চলে তালপাতা সংগহের কাজ। কারিগররা সেই তালপাতাকে কেটেছেঁটে পানিতে ডুবিয়ে নরম করে মূল পাখার আকৃতিতে নিয়ে আসে। তারপর চলে পাখা বাঁধার কাজ। অত্যন্ত নিপুণ হাতে করতে হয় এই পাখা তৈরির কাজ। একেকটি তালপাখা তৈরিতে খরচ ১২-১৫ টাকা হলেও তালপাখার চাহিদা অনুপাতে বিক্রি হয় ২৫-৮০ টাকা পর্যন্ত। বিভিন্ন ব্যাপারী ও বাজারে বিক্রির মাধ্যমে এই পাখা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
পারিয়াট গ্রামের নুরুদ্দিন বিশ্বাস-শিউলি বেগম দম্পতি। পাখা তৈরি করেই চলে তাদের সংসার। এই দম্পতি এ পেশায় রয়েছে কমপক্ষে ৪০ বছর ধরে। নুরুদ্দিন বিশ্বাস জানান, পারিবারিক ভাবে পাখা তৈরির কাজ করে আসছেন তিনি। বাবা-দাদারা এই কাজ করে গেছেন। তাদের থেকেই তিনি এই কাজ শিখেছেন। তাদের কাছে এটি একটি শিল্প। বিভিন্ন জেলা থেকে তালপাতা ক্রয় করে নিয়ে আসেন। পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে একটি পাখা তৈরি করা হয়। একটি পাখা তৈরি করতে ১০-১৫ টাকা খরচ হয়। পাইকারি ভাবে ২৫-৩৫ টাকা পর্যন্ত পাখা বিক্রয় করা হয়। কোনো সময় এর থেকে বেশিও হয়। চলতি বছর তারা বিগত বছরের তুলনায় এবার অধিক মুল্যে বেশি পাখা বিক্রি করেছে। চাহিদা ছিল অনেকটাই বেশি বলে তারা জানান। গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতপাখার চাহিদা শুরু হয়। তবে গরম বেশি পড়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে শহরে হাতপাখার কদর বেড়েছে। এদিকে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইকারিতে পাখার দামও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এসব ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা আক্ষেপ করে জানান, প্লাস্টিকের বানানো পাখা ও বিভিন্ন বাহারি ডিজাইনের রেডিমেড পাখা তাদের ব্যবসায় ঢল ফেলেছে।
আশ্বিন মাস থেকে শুরু করে অগ্রাহায়ন ও পৌষ মাস পর্যন্ত রাজবাড়ি, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তালপাতা সংগ্রহের কাজ চলে। এরপর মাঘ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত পুরোদমে পাখা ক্রয়-বিক্রয় হয়। এতে লাভ আছে, তিন্তু লোকসার হয় না। চাহিদা অনুযায়ী লাভের পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। ৫০ হাজার টাকার পাতা কিনলে এক লাখ থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাখা বিক্রয় করা যায়। এ বছর তীব্র গরমের কারণে তালপাখার চাহিদা অনেক বেশি। গ্রাম থেকে ব্যাপারীরা পাইকারি হারে প্রতি পাখা ২০-৩৫ টাকা দরে ক্রয় করে নিয়ে যান। পরে তারা সেগুলো বিভিন্ন জেলায় বিক্রয় করে। কারিগররা পাখা তৈরি করে তেমন বেশি লাভ করতে না পারলেও ব্যবসায়ীরা একটি পাখাতে ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভ করে থাকেন। শিউলী বেগম বলেন, বাড়ির পুরুষরা পাতা কেটে নিয়ে আসেন। পরে সে গুলোকে রোদে শুকিয়ে পানিতে পচাতে হয়। পচে গেলে সে গুলোকে আবার শুকাতে হয়। তারপর পাখার আকার দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাঁশের শলা রং দিয়ে সুতা বাঁধতে হয়। এখন পারিয়াট গ্রামকে সবাই পাখা গ্রাম বলেই চিনে।
বৃদ্ধা ছবিরণ নেছা জানান, বিয়ের আগে কখনো তালপাখা তৈরির কাজ করেননি তিনি। বিয়ের পর থেকে দেখেছেন শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামীকে এই তালপাখা তৈরি করতে। সেই সময় থেকে তিনিও তালপাখা তৈরির কাজ করেন। স্বামী মারা যাওযার পর ছেলে শীতের সময় ফরিদপুর, মাদারীপুর, শিবচর, সন্নাসিরচর এলাকা থেকে তালপাতা নিয়ে আসে। সেই তালপাতা দিয়ে পাখা তৈরি করা হয়। নিজেদের কোনো জায়গা-জমি নেই। এই তালপাখা তৈরি করেই সংসার চলে তাদের। বছরের ১০ মাস এই কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হয় তাদের। পারিয়াট গ্রামের আম্বিয়া খাতুন বলেন, তাদের গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার এই পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িত। মৌসুমে প্রত্যেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার পাখা তৈরি করেন। আশ্বিন, আর্তিক ও অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরির কাজ চলে। পাইকারি মহাজন গ্রাম থেকেই এসব পাখা নিয়ে যান। শুধু বর্ষা সিজনে বিক্রয় কম হয়। গরমে প্রচুর চাহিদা থাকে।
এই পাখা তৈরি বা ব্যবসায়ের জন্য ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে কোনো ঋণ পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে ভিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয় কিংবা সুদে টাকা নিয়ে এই ব্যবসা করতে হয়। ফলে বেচাকেনা শেষে দেখা যায় ঋণের টাকা পরিশোধ করতেই সব টাকা শেষ।
কালীগঞ্জ উপজেলার কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দীন আল আজাদ বলেন, পারিয়াট গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পাখা তৈরির এই পেশার সঙ্গে জড়িত। যুগের পর যুগ ধরে এই পেশা চলে আসছে। তারা যদি সরকারি ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণ পেত তাহলে ভালো ভাবে ব্যবসা করতে পারতো।