নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের গোড়া পত্তন হয়েছিল বৃটিশ কোম্পানি শাসনামলে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে স্থাপিত হলে সৈয়দপুর শহরের গুরুত্ব বেড়ে যায় বহু গুণ। সে সময়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সৈয়দপুর ছিল একটি ছোট্ট রেলওয়ে ষ্টেশন। ওই রেলওয়ে ষ্টেশনের সোজা উত্তর পাশে স্থাপন করা হয় ছোট একটি লোকোশেড। ওই লোকোশেডটি ছিল দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানার ভিত্তিভূমি। পরবর্তীতে ওই লোকোশেডটি ঘিরেই ১১০ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল রেলওয়ে কারখানা। এ কারখানাটি স্থাপনে ব্রিটিশরা বিবেচনায় নিয়েছিল এর অবস্থান, জলবায়ু ও পরিবেশগত অবস্থার। এ কারখানায় কাজ করতো বহু ব্রিটিশসহ এ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্টান্ট খ্রীষ্টান। আর তখন এদের জন্য গড়ে তোলা হয় বেশ ক’টি আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে সাবোর্ডিনেট কলোনি বা সাহেব পাড়া ছিল অন্যতম। এখানে ব্রিটিশ বা এ্যাংলো ইন্ডিয়ান খ্রীষ্টানদের বসবাস ছিল বলেই এ কলোনীর নাম ছিল সাহেবপাড়া। বর্তমানে সারাবিশ্বের ২৩১ কোটির অধিক মানুষ খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে খ্রিষ্টান জনগণের সংখ্যা ৫ লক্ষ্যাধিক এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইতিহাস চারশ বৎসরের অধিক। এদেশের জনপদের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। এদেশের আলো, বাতাস এবং মাটিতে তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বসবাস। ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্য কোন দেশ থেকে আসা মানুষ তারা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় সৈয়দপুরে ২টি ঐতিহাসিক গির্জা গড়ে উঠে। সেই ২টি গির্জা নির্মিত হয়েছিলো বিট্রিশ শাসনামলে। প্রথম গির্জাটি হলো সৈয়দপুর ক্রাইস্ট চার্চ (চার্চ অব বাংলাদেশ) যা স্থাপিত হয়েছিলো ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের সমসাময়িক সময়ে। এটি অবস্থিত রেলওয়ে হাসপাতাল সংলগ্ন। এ চার্চের বর্তমান সভাপতি হলেন রেভারেন মার্টিন হিরা মন্ডল (পাদ্রি, পুরোহিত) এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন মিস্টার প্রদিপ বিশ্বাস। এই চার্চের খ্রিষ্ট ভক্ত সদস্য সংখ্যা হলো ২১৬ জন। দ্বিতীয় গির্জাটি হলো লুর্দের রানি মারীয়া (রোমান ক্যথোলিক চার্চ) যা স্থাপিত হয়েছিলো ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। এটি অবস্থিত রেলওয়ে কারখানা সংলগ্ন (শ্রমিকলীগ অফিসের দক্ষিণ পার্শ্বে)। এই চার্চের বর্তমান সভাপতি হলেন ফাদার যোসেফ মারান্ডী (পাদ্রি, পুরোহিত) এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন মিস্টার নিকোলাস গমেজ। এই চার্চের খ্রিষ্টভক্তের সংখ্যা হলো ১৯৮ জন। বড়দিন বা ক্রিস্টমাস ও পুণুরুত্থান বা স্টার সানন্ডে এই ২টি হলো খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য বৃটিশ সরকার সাহেব পাড়ার দু’প্রান্তে দু’টি গীর্জা নির্মাণ করেন। গীর্জা দু’টির মধ্যে একটি ছিল রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের এবং অপরটি ছিল প্রোটেষ্টান্ট সম্প্রদায়ের। এ গীর্জা দু’টি উত্তরাঞ্চলের সর্বপ্রথম ও প্রাচীনতম গীর্জা। এর নির্মাণ শৈলী ছিল রোমান ইউরোপীয় স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রেলওয়ে কারখানা গেট সংলগ্ন গীর্জাটি কুমারী মারিয়মের নামে উৎসর্গ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৯২ সালে গীর্জার পাশেই রেলওয়ের ৩ বিঘা জমির ওপর একটি পুরোহিত ভবন নির্মাণ করা হয়। তখন ফাদার ফ্রান্সির বোকালিমে যিশু খ্রীষ্টের ভক্তদের নিয়ে আধ্যাত্মিক কর্মকা- পরিচালনা করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ইংরেজ ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেও কিছু সংখ্যক এ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এখানেই থেকে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর কিছু দিন পূর্বে অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অষ্ট্রেলিয়া চলে যায়। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৬ এপ্রিল সৈয়দপুর গণহত্যা শুরু হলে অবাঙ্গালী ও পাক সেনাদের হাতে নিহত হয় বেশ ক’জন খ্রীষ্টান। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ সংকটকালেও ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টীন্ট সম্প্রদায়ের বহু খ্রীষ্টভুক্ত গীর্জা ও সিস্টারদের কনভেষ্টে অবরুদ্ধ জীবনযাপন করে। সৈয়দপুর পুরানো গীর্জা ও পুরোহিত ভবন নির্মাণের পর সিস্টার অব চ্যারিটি সম্প্রদায়ের খ্রীষ্টানরা (সিস্টাররা) এই ধর্মপল্লীতে আসেন। পরে এদের প্রচেষ্টায় সেন্ট জেরোজা নামে একটি নার্সারী স্কুল চালু করা হয়। বর্তমানে স্কুলটির ভাল মানের লেখাপড়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। তাইতো এ স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে হুমড়ী খেয়ে পড়ে অভিভাবকরা। সে সময় সৈয়দপুরের এ রেলওয়ে কারখানাকে কেন্দ্র করে এ এলাকায় আগমন ঘটেছিল ব্রিটিশ ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের। কালের বিবর্তনে তারা আজ না থাকলেও রয়ে গেছে ক্ষুদ্র পরিসরে তাদের গড়া ধর্মপল্লী, সাবোর্ডিনেট কলোনি বা সাহেবপাড়া। সে সাহেবরা আজ নেই। কিন্তু রয়ে গেছে সাহেব পাড়ার দু’প্রান্তে তাদের গড়া দু’টি দর্শনীয় গীর্জা। যার স্থাপত্যকলা ও নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করে সৈয়দপুরে আগত প্রতিটি মানুষকে।