আবরো হরতাল ফিরে এসেছে। ছাত্র-যুব-জনতাবিরোধী এমন কর্মসূচি অতিতেও দেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, এখনো করছে। জামায়াত-বিএনপি-শিবির-সংহতি-পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্লাটফর্মের ডাকা হরতালের বিপরীতে অবশ্য সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এরা বেশি বেশি করলে, এদের বাড়াবাড়ির জবাব দেওয়া হবে। পালটা জবাব গড়ে তুলে অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। বিএনপির কর্মসূচি থেকে পুলিশের ওপর হামলা, এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, কাকরাইলে পুলিশ বক্সে আগুন, মসজিদের সামনে বাসে ও পিকআপে হামলার প্রসঙ্গ তুলে ওবায়দুল কাদের বলেন, এর কৈফিয়ত বিএনপি-জামায়াতের দিতে হবে।’
ওবায়দুল কাদের যা বলুন আর তা বলুন, আমরা জানি- এক দিনের হরতালে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। অতিতে বিএনপি জোটের টানা হরতাল-অবরোধের কারণে দেশে উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছিলো চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫৫ শতাংশ। সেই সময়ের ৮১ দিনের হরতাল-অবরোধের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছিলো। যে যেভাবেই হিসাব করুক, রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হয়েছে, এটা সত্য। কিছু বছর পর এসে ক্ষমতায় আসবার আর থাকবার চেষ্টায় অপরাজনীতিতে মেতে উঠছে ছাত্র-যুব-জনতা বিরোধী-দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক প্লাটফর্মগুলো। সেখানে আছে ছাত্র-যুব-জনতাবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চ- মোর্চা- জোট এবং যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতারা। তাদেরই আন্দোলনে নির্মমতায় মেতে ওঠে দেশ-স্বাধীনতাবিরোধীচক্র। এই অপরাজনৈতিক চক্রের সদস্যরা রাজনীতির নামে মানুষের ভোগান্তি বাড়াতে তাদের মরণকামড় দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। কামড় দিয়ে জীবন নিয়েছে ছাত্র-যুব-জনতার পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের সদস্যদের জীবনও। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে আবারো হরতাল ডেকেছে ছাত্রশিবির-জামায়াতদ্বারা রাজনৈতিক প্রভাবিতস বিএনপিসহ বেশ কিছু ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। হরতালের আগেই তারা রাজনীতির নামে অপরাজণৈতিক কৌশলের পথ ধরেছে। অগ্নিসংযোগ করেছে, পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। অথচ এই রাজনীতিকেরাই বড় বড় কথা বলেন, শান্তির জন্য-ধর্মের জন্য। কিন্তু কোন ধর্ম কি কখনো অশান্তি তৈরির পক্ষে কথা বলেছে? বলেনি। তাহলে কেন নির্মমতার রাজনৈতিক পথচলা? লোভ, লোভের কারণে নির্মমতায় মেতে ওঠা এইসব হায়েনাদের রাজনীতির কারণে র্নিমমভাবে বাংলাদেশ হারিয়েছে অতিতের দিনগুলোতে প্রতিদিন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর আগে টানা ১৬ দিনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪৪৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা গত বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
নতুন করে শুরু হওয়া হরতাল-অবরোধে আবারো দেশের সবগুলো খাতই আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা করছি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে আবারো। বাড়বে দ্রব্যমূল্যও। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে অবশ্যই সমঝোতায় আসতে হবে, যেন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কারণ শক্তি প্রয়োগ করে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। আবার শুধু এখনকার সমস্যা সমাধানের পথ বের করলেই চলবে না, যেকোনো রাজনৈতিক সংকট এমনভাবে সমাধান করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে একই ধরনের সংকট তৈরির কোনো সুযোগ না থাকে। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপই একমাত্র পন্থা। পৃথিবীর কোনো দেশেই চাপ কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে সমস্যার কাক্সিক্ষত সমাধান হয়নি। বিদ্যামান সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে সংলাপ আয়োজনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আওতায় সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং নির্দিষ্ট স্থানে সভা-সমাবেশ করার অধিকার থাকায় বিশ্বাসী। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন কোনো অবস্থাতেই সহিংস হওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন প্রত্যাশা করি। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বলতে চাই- আমরা রাজপথে হরতাল নয়, শান্তির চর্চা চাই।
প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অযুহাতে সারাদেশে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এটা সত্য কথা যে, বর্তমানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিদিন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এরইমধ্যে যদি হরতাল বা এমন তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মসূচি চলতে থাকে, তাহলে প্রতিদিন ২ হাজার ২৭৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ক্ষতির অঙ্ক কষতে হবে বাংলাদেশকে। অতিতের হরতাল-অবরোধের অতিতে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়- সে সময় প্রতিদিন শিল্পকারখানায় সক্ষমতার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম পণ্য উৎপাদিত হয়েছে। সে হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিলো আড়াই হাজার কোটি টাকায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রাক্কলিত জিডিপিতে শিল্প খাতের এক দিনের অবদান ৮৭৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিল্প খাতে সক্ষমতার ২৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে প্রতিদিন উৎপাদন কম হয়েছে ২১৮ কোটি ৯৬ কোটি টাকা। এর প্রভাবে শিল্পকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রবণতা বেড়েছিলো। শুধুমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, ভারতসহ প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের পোশাকশিল্পে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে উঠছে।
খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাঁতি আজ যখন তখন হরতালের আশঙ্কায় দিনাতিপাত করছে। এমতবস্থায় তাদেরকে জানাতে চাই- একদিনের হরতাল-অবরোধে কৃষি খাতে ২৮৮ কোটি, পোলট্রিশিল্পে ১৮ কোটি ২৮ লাখ, হিমায়িত খাদ্য খাতে ৮ কোটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৩০০ কোটি, পর্যটনশিল্পে ২০০ কোটি, আবাসন খাতে ২৫০ কোটি, শপিং কমপ্লেক্সসহ দোকানপাট খাতে ১৫০ কোটি, প্লাস্টিক পণ্য খাতে ১৭ কোটি ৮৫ লাখ, বিমা খাতে ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। হরতালে পরিবহন খাতে অচলাবস্থার কারণে গ্রামাঞ্চলে সার, পানি সেচের জন্য জ্বালানি তেল, বালাইনাশক সময়মতো পৌঁছাবে না, এতে করেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীরা আবারও আস্থা হারাতে পারেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা বেশি ক্ষতির শিকার হন গুজবের কারণে। একদিনের হরতালের কারণে আজকে যে ক্ষতি হচ্ছে, কাল সেটা পোষানো যাবে না। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এটা ফিরে পেতে সময় লাগবে। কৃষিপণ্য তো পচে যাবে। সেটা ফিরে পাবে বাংলাদেশ?
পোশাক রপ্তানিতে বাধা ৬৯৫, পরিবহন ও যোগাযোগ ৩০০, কৃষি খাত ২৮৮.১, আবাসন খাত ২৫০, পর্যটন খাত ২১০, বাজার খাত ১৫০, পোশাক খাত ১৪৭.৫, উৎপাদন খাত ১০০, রাজস্ব খাত ৩৩, সিরামিক খাত ২০, পোলট্রি শিল্প খাত ১৮.২৮, প্লাস্টিক দ্রব্য খাত ১৭.৮৫, বিমা খাত ১৫, হকার্স খাত ১৫, পণ্য খালাস খাত ১০, হিমায়িত খাত ৮ কোটি টাকার ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচাতে চলুন নিরন্তর হরতালহীন পথে হাঁটি।
হরতালহীন দেশ গড়তে চলুন আওয়াজ তুলি ‘হরতাল নয়-শান্তি চাই।’ অবশ্য দেশের সবচেয়ে বেশি হরতালকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এরইমধ্যে বলেছেন- বিএনপির নৈরাজ্যের হরতাল কেউ মানবে না। হরতাল অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেছে। এই ভোঁতা অস্ত্রে কাজ হবে না। রোববার (আজ) মহানগর, থানা, জেলা, উপজেলাসহ সারা বাংলাদেশে শান্তি সমাবেশ হবে। আমরা শান্তির পক্ষে, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে। আমরা শান্তি চাই। আমরা নির্বাচনের আগে শান্তি চাই, নির্বাচনের সময় শান্তি চাই, নির্বাচনের পরেও শান্তি চাই... (মোমিন মেহেদী : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস)