আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। জাতীয় পার্টির (জাপা) শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে আওয়ামী লীগ অর্ধ ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকলেও আসনটি ধরে রাখতে চায় জাপা।ও জামায়াতের বিএনপি-জামায়াত জ্যামিতিক ত্রিভুজে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এ আসনে ইতোমধ্যেই সরকারের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। জয়ের আশা করছে জাতীয় পার্টিও। আন্দোলনে সক্রিয় হয়েও নির্বাচনের নীরব প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। নিজেদের একক প্রার্থী ঠিক করে ভোটের মাঠে রয়েছে জামায়াত। সবাইকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ভোটারদের দোয়া চেয়ে রং-বেরংয়ের ব্যানার ফেষ্টুন ছাপিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
জোটগত সমীকরণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলেও এবার কী হবে তার হিসেব মিলছে না। ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দাবী করে আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে জাতীয় পার্টি আশাবাদী হলেও এবার মাঠ ছাড়তে যেন নারাজ আওয়ামী লীগ। এ আসনে দলের একক প্রার্থী চান তারা। তবে মাঠ চষে বেরাচ্ছেন আওয়ামী লীগের উপজেলা সভাপতি মিসেস আফরুজা বারী, সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম সরকার লেবু, উপজেলা আওয়ামলীগের সগ সভাপতি ও প্রয়াত এমপি শহীদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের সহধর্মিনী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দা মাসুদা খাজা, ছাত্রলীগ নেতা আখতারুজ্জামান সাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রঞ্জু মিয়া ও গাইবান্ধা জেলা পরিষদ সদস্য এমদাদুল হক নাদিম। এদিকে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের চমক দেখাতে চায়। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাপা চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের সম্প্রতি দলের জেলা সম্মেলনে জানান- ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দলটি। পাশাপাশি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ভাবনাও উড়িয়ে দিতে নারাজ জাতীয় পার্টি। অপরদিকে জামায়াত তাদের একক প্রার্থী নির্ধারণ করে ভোটের মাঠে তলে তলে নিজেদের গুছিয়ে নিতে ‘গ্রাউ-ওয়ার্ক’ সেরে ফেলছেন। জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হিসিবে পরিচিত সুন্দরগঞ্জ। দলের মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে এবার এ আসনটি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা দেখছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। সরকার পতনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় দলটির নেতাকর্মীরা। তবে আপাতত তাদের মূল ভাবনায় আন্দোলন থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতিও যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা না থাকলেও চলছে নির্বাচনি হোমওয়ার্ক।
জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার একটি পৌরসভা ও পনেরটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত গাইবান্ধা-১ সংসদীয় আসন। এখানে ১১৪টি ভোট কেন্দ্রের মাধ্যমে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ১৪৬ জন। এ আসনে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ্যাড. মোহাম্মদ শামসুল হোসেন সরকার, ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে ইসলামি ডেমোক্রেটিক লীগের (আইডিএল) অধ্যাপক মোহাম্মদ রেজাউল আলম খন্দকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া হাফিজুর রহমান প্রামাণিক ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৮৮ সালের চতুর্থ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) ষষ্ঠ নির্বাচনে বিএনপির বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকারিয়া হোসেন খন্দকার এবং ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ওহায়েদুজ্জামান সরকার বাদসা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে মাওলানা আব্দুল আজিজ নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আবদুল কাদের খান আসনটি পুনরুদ্ধার করে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচল্লিশ বছর পর এ আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলিতে সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন নিহত হলে আসনটি শুন্য হয়। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের গোলাম মোস্তফা আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গোলাম মোস্তফা আহমেদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ পুনরায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিজয়ী হন। সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জাতীয় পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য না থাকায় উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অনেকটাই পিছিয়ে আছে সুন্দরগঞ্জ। আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধার করে এলাকার উন্নয়নকে বেগবান করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।
অন্যদিকে আন্দোলনে বিএনপির নজর থাকলেও প্রস্তুতি রয়েছে নির্বাচনেরও। মামলা আর গ্রেপ্তার আতঙ্ক কাটিয়ে স্থানীয় রাজনীতির মাঠে এখন সাংগঠনিক তৎপরতায় বিএনপি অনেকটাই সুসংগঠিত। রাজনীতির মাঠের বিপর্যয় কাটিয়ে নতুন কৌশল নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। বাস্তবতার নিরিখে পথ চলতে চান দলের নেতারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষিত না হলেও ভোটের মাঠে রয়েছেন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই। বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন- জেলা বিএনপির সহসভাপতি অধ্যাপক ডা. খন্দকার জিয়াউল ইসলাম, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক মো. বাবুল আহমেদ, সদস্যসচিব মাহমুদুল ইসলাম প্রামাণিক ও পৌর বিএনপি নেতা ইফতেখার হোসেন পপেল।
এছাড়া আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামি ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা দাবি এবং জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে শক্তি দেখাতে চাইছে। একই সঙ্গে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি রয়েছে। ইতোমধ্যে এ আসনে তারা প্রার্থীও ঠিক করেছে। তবে আপাতত দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেই থাকতে চায়। এজন্য তারা নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে। এমনটাই জানিয়েছেন দলটির জেলা নেতারা।গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দলটির গাইবান্ধা জেলা শাখার নায়েবে আমির ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাজেদুর রহমান এর নাম শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে এখানে জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ আর জামায়াতের মধ্যেই ত্রিমূখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে সাধারণ ভোটারদের ধারণা।