আধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণে বালু একটি অপরিহার্য সামগ্রী। দেশে যেহেতু শিল্পণ্ডকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাঁচ্ছে, সেহেতু আগামীতেও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর পাশাপাশি বালুর ব্যবহার আরও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে দিনেদিনে পরিবেশ ও মানুষের জানমাল ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। নদণ্ডনদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ নতুন নয়। বালুসন্ত্রাস এবং অবৈধ বালুমহাল বাংলাদেশের জন্যও এক নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ৭০০ নদীবিধৌত বাংলাদেশের প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার নদী রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, তুরাগ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, করতোয়া, তিস্তা, ফেনী নদসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীতেই সংঘবদ্ধ চক্র বালুমহাল নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। নদী ভাঙনের জন্য যে কারণগুলো প্রধানত দায়ী থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। এই বালু উত্তোলনের ফলে কোনো একটি স্থানে হঠাৎ করে গভীরতা বেড়ে যায়। উজানের পানি এসে সেখানে ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয়। সেই ঘূর্ণিপাক তীরে গিয়ে আঘাত করে এবং এতে করে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। নগরায়নের জন্য বালু একটি অপরিহার্য উপাদান কিন্তু বালু তোলার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানতে হয়। প্রকৃতির বিভিন্ন উৎস থেকে নিয়ম মেনে বালু তোলার ভালো দিকও রয়েছে। বালু তুলে দারিদ্র্যবিমোচন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। আবার উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন আবাস ও নতুন জলাধার সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে বালু উত্তোলন করলে উল্টো পরিবেশের ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে দেশের বিপুল পরিমাণ বালুর চাহিদার কারণে দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সিন্ডিকেট, যার বেশির ভাগই অবৈধ। এরা নদী, খাল, পাহাড়ি ছড়া, এমনকি কৃষিজমি থেকে অবৈধভাবে মাটি ও বালু উত্তোলন করছে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। কিন্তু সেসবের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এতে সরকার যেমন বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি নদী-ভাঙন, পাহাড়ধস ত্বরান্বিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেখা যায় দেশের বিভিন্ন নদণ্ডনদী থেকে প্রায়ই প্রভাবশালী মহলের অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে। স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের যোগসাজশে বালু উত্তোলন করা হয় বলে অভিযোগ আছে। বালুমহাল ইজারার ক্ষেত্রেও মানা হয় না কোনো নীতিমালা। এমতাবস্থায় অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে সরকারের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। তাই প্রথমত নদী খননের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে, যে কোন জায়গা থেকে বালু বা মাটি তোলা হবে এবং কতটুকু তোলা হবে। পরবর্তীতে সে অনুযায়ী বালু উত্তোলন করতে হবে। প্রতিদিন দেশের নদীগুলোতে ড্রেজার দিয়ে তলদেশ থেকে একটানা উত্তোলন করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বালু। এসব উত্তোলন পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করতে হবে ও ড্রেজারগুলো জব্দ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এগুলো কাজে লাগানো না যায়। পাশাপাশি পরিকল্পিত খনন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তুলে নদনদী নাব্য করা জরুরি। এতে ক্রমবর্ধমান বালুর চাহিদাও পূরণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, নীতিমালা ও ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। কোন নদীতে কোথায় কি পরিমাণ বালু তোলা যায় তা খতিয়ে দেখে পরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হলে বালুর চাহিদা যেমন পূরণ হতে পারে, তেমনি নদনদীর নাব্যতা ফেরাতেও এর বিকল্প নেই। সর্বোপরি যেকোনো মূল্যে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি নদীর তীর ও পরিবেশ রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে।