আত্মহত্যা মহাপাপ, প্রত্যেকটি ধর্মমতেই আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং আত্মহত্যাকারীর প্রতি মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য কঠোর হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও মানুষ আত্মহত্যা করে। কিন্তু যখন একটি দেশের ভবিষ্যৎ তথাপি শিক্ষার্থীরা যখন আত্মহত্যা করে তখন তা ওই দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ। সম্প্রতি দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা। এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে আত্মহত্যা করেছেন মোট ৩৬১ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, যা মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩.৭৭ শতাংশ। এরপরই চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ১৬ দশমিক ৮১ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ, রংপুরে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং সিলেট বিভাগে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩.৯০ শতাংশই বাকি ৩৬.১ শতাংশ ছেলে। এদের বেশীরভাগই পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষণ্ণতা থেকে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। যদিও স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার কারণের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা রোমান্টিক সম্পর্কে ব্যর্থ হওয়া এবং আর্থিক সংকটের কারণেই বেশি আত্মহত্যা করে থাকে। কিন্তু স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পড়ুয়া আত্মহত্যার করা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এই পথ বেছে নেয় পরিবারের সদস্যদের উপর মান-অভিমানের কারণে। গত রোববার প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি-সমমান পরীক্ষার ফলাফল, যাতে পাশের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮.৬৪ শতাংশে এবং কমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়, ইতোমধ্যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা অকৃতকার্য হওয়ার ভয়ে ৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। যা কিনা বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই এখনি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু দেখা যাচ্ছে বেশীরভাগই আত্মহত্যাই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে হয়ে থাকে তাই প্রথমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌঁসুলি ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বাবা মায়েদেরও সচেতন হতে হবে, সন্তান পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাকে ভর্ৎসনা না করে সান্ত¡না দিতে হবে। সরকারকে শিক্ষার্থীদের হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এই অকালে দেশের মেধা যদি ঝড়ে পড়া থামানো না যায় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক প্রচারণা, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং আত্মকর্মসংস্থান তৈরি, কমিউনিটি ও পরিবারের সহায়তায় হতাশামুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে এখনই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।