একটা দেশের ভবিষ্যৎ চাহিদা, সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনা মাথায় রেখে গড়ে তোলা হয় সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। একজন নাগরিককে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও পেশাগত জীবনের দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলাই এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। শিক্ষা যত মানসম্মত হবে, আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে তত বেশি। মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমেই একজন মানুষ উন্নয়নের যথার্থ কারিগর হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষা মানেই মানসম্পন্ন শিক্ষা। সে কারণে প্রতিটি দেশের উন্নয়নের মূল শর্ত শিক্ষিত মানুষের হার বৃদ্ধি করা। তবে লক্ষ রাখতে হবে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যেন বাস্তবায়িত হয় এবং শিক্ষার প্রায়োগিক উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা না হয়। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল করার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপথগামী করে তুলেছে। বলতে গেলে এখন আর স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় না, ভর্তি হয় পরীক্ষার্থী। কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের ফল। এবার ছাত্রছাত্রীদের অংশ নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে নামে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। প্রতিটি অভিভাবকই চায় তার সন্তান সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হোক। কিন্তু দেশে এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বা অসুস্থ প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে এখন শেখার বিষয়টি গৌণ হয়ে গেছে। দেশের প্রত্যেক অভিভাবকের একান্তই আকাক্সক্ষা তার সন্তানকে অবশ্যই জিপিএ-৫ পেতে হবে। তা না হলে তারা সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হবেন, তাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। ফলে শিশু শিক্ষার্থীরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মুখস্থ পাঠ, নোটবই নির্ভর পড়াশোনা, কোচিংয়ের চাপ ও মডেল টেস্ট ছাড়া পড়াশোনা বলতে আর কিছু বোঝে না। এতে করে দেখা যাচ্ছে অজান্তেই অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে। এতে করে তাদের যথাযথ মেধা ও মননের বিকাশ তো হচ্ছেই না; বরং জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা তাদের নৈতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে হাজার হাজার পাস করা শিক্ষার্থী পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারছে না। সম্প্রতি সময়ে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর উচ্চমাধ্যমিকে বাড়ছে জিপিএ ৫’ র সংখ্যা, কিন্তু এইসব শিক্ষার্থীর বিশাল একটি অংশ যখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যায় তখন অকৃতকার্য হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইনের সর্বশেষ যে খসড়া তৈরি করেছে, তাতে নোটবই ও গাইড বই বাতিল করার কথা বলা হলেও কোচিং সেন্টার থাকবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেদারে চলছে কোচিং ব্যবসা ও গাইড বই বিক্রির হিড়িক। তাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এখনি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সনদনির্ভরতা কমিয়ে এনে তা জ্ঞান বা কর্মনির্ভর করা প্রয়োজন। শিক্ষা শেষে কর্মে প্রবেশের পন্থাও সময়োপযোগী করতে হবে। দেশে উচ্চশিক্ষার এত প্রতিষ্ঠান, এত শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বুঝাতে হবে, একজন মানুষের উচ্চশিক্ষা লাভ করার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষা নেওয়াটাও জরুরি। উচ্চশিক্ষা শুধু সার্টিফিকেটে উচ্চ হলেই হবে না, মন ও মননশীলতায় উঁচু হতে হবে। সেই মানসিকতা গড়তে শুধু নামীদামী ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলেই চলবে না। শিক্ষাব্যবস্থায় অসুস্থ, অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত প্রতিযোগিতা রুখতে পারলে জাঁতি অচিরেই একটি শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বাদ পাবে, ফিরে পাবে সত্যিকারের স্বাধীনতা। তাই সর্বোপরি শিক্ষার সব স্তরে মান উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে দেশে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, ভর্তি আতঙ্ক ও নানামুখী ভোগান্তি কমবে। সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষার গুণগত মানেও পরিবর্তন আসবে।