দেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। কোনভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। এসব দুর্ঘটনার বেশীরভাগই সংগঠিত হয় দেশের সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে। বাংলাদেশে বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুহার উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। শিশু ও কর্মক্ষম বয়সের মানুষ বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ে বাংলাদেশ অনেক আগেই বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে। তা সত্ত্বেও আমাদের সড়ক-মহাসড়ক মানসম্পন্ন নয়। প্রতিবছরই এসব সড়ক সংস্কারে রাষ্ট্রের বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হয়। আবার পরের বছরে তা নতুন করে সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। বর্ষাকালে বেহাল সড়ক সম্পর্কে জনমনে রোড ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা আছে। সড়ক দ্রুত নষ্ট হওয়া নিয়ে প্রায় সব সময়ই পরিবহণ মালিক ও রোড ইঞ্জিনিয়াররা একে অন্যকে দোষারোপ করে থাকে। সড়ক তৈরির ক্ষেত্রেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে দেখা উচিত। নিরাপদ সড়ক তৈরির জন্য সুবিধামতো রাস্তার নকশা করা এবং এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে কাজ করাটা জরুরি। কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই তা করা হয়না। দেখা যায়, একটি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক গতানুগতিক কার্পেটিং সড়ক এবং ইট বিছিয়ে দিয়েই বরাদ্দ শেষ করা হয়। ফলে সরকারি বরাদ্দের সড়ক নির্মিত হয় ঠিকই কিন্তু টেকসই হয় না। এতে করে বাড়ে জনদুর্ভোগ, পণ্য পরিবহন হয় বিঘ্নিত; যানবাহনের ক্ষতিও কম হয় না। আবার দেখা যায়, অধিকাংশ সময়ই সড়ক নির্মাণে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ সড়কেই ব্যবহার হচ্ছে ৮০-১০০ গ্রেড তথা নিম্নমানের বিটুমিন। সড়কের স্থায়িত্বের জন্য সঠিক মানের বিটুমিন ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে বিটুমিন দিয়ে তৈরি সড়ক টেকসই হয় না। বিটুমিন হলো প্রাকৃতিকভাবে অশোধিত তেলের উপজাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে সড়কে ফাটল ধরতে দেখা যাচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও অত্যধিক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিটুমিনের সড়ক আগের মতো টেকসই থাকছে না। দেশে বেশীরভাগ সড়ক নির্মাণে ব্যবহার হয়ে থাকে সিমেন্ট, লাইম, ফ্লাই অ্যাশ, বিটুমিন ইমালশন, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম সিলিকেট, বায়ো-এনজাইম প্রভৃতি। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির আধুনিকায়নে আধুনিক বিবিধ কেমিক্যালগুলো সয়েল স্টাবিলাইজেশনে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ আধুনিক দেশে রাস্তা সংস্কারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যাক্রিলিক পলিমার নামের একটি কেমিক্যাল। এই পলিমারটি মাটি ও বালির ভার বহন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও পানিরোধী করে। অ্যাক্রিলিক পলিমার মাটি ও বালির সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে মাটি ও বালির প্রতিটি কণার সঙ্গে মিশে ন্যানো-পরিমারাইজ্ড গ্রিড তৈরির মাধ্যমে একটি বিশেষ স্তর সৃষ্টি করে। এ স্তরটি ক্ষয়রোধী ও স্থিতিস্থাপক গুণাগুণসম্পন্ন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাটি ও বালি অ্যাক্রিলিক পলিমার ব্যবহারে বিশেষ উপযোগী এবং আবহাওয়া গ্রীষ্মমন্ডলীয় হওয়ায় দ্রুত শুকিয়ে যায়। তাই সরকারকে এখনি টেকসই সড়ক নির্মাণে গুরুত্ব দিতে হবে। গতানুগতিক বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ থেকে সরে আসতে হবে ও সড়কগুলোতে অ্যাক্রিলিক পলিমারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারকারী ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। সড়ক নির্মাণের পর সেটি বুয়েট দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে সনদ দেওয়ার পরই ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করতে হবে। সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার বন্ধ করা গেলে প্রতিবছর রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে টেকসই সড়ক নির্মাণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।