জন্মগতভাবে রোগাক্রান্ত, দুর্ঘটনা, অপচিকিৎসা বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষমদেরই প্রতিবন্ধী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসটি ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করা হচ্ছে। ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে সংঘটিত হয় এক খনি দুর্ঘটনা। এ ঘটনায় মারা যায় অনেক মানুষ এবং সারা জীবনের জন্য প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয় পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই এই দিবসটির সূচনা। দেশের জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ হলো এই প্রতিবন্ধীরা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানব বৈচিত্র্যের অংশ। বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় নানা ধরনের শারীরিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সমাজের মূলস্রােতধারার বাইরে থাকে। প্রতিবন্ধীদের পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী, সবাই খাটো করে দেখে। সমাজের বাকি সদস্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনের কথা থাকলেও, তারা হয় সব অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই তারা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধীতার ধরনগুলো হচ্ছে-অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিন্ড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ১৫ জন প্রতিবন্ধী। দেশের এত বড়ো একটি জনগোষ্ঠী আজ অবহেলার কারণে ধীরেধীরে পিছিয়ে পড়ছে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিটি মানুষের মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মেধা ও দক্ষতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হলে তাদের উপযুক্ত পরিচর্যা ও প্রশিক্ষিত করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চাকরি উভয় জায়গায় প্রতিবন্ধীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সমর্থন ও সহায়তা দিতে হবে। প্রতিবন্ধীরা এখন প্রতি মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পান, এই ভাতার পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। শিক্ষা একটি বড় অন্তরায় প্রতিবন্ধীদের জন্য। বর্তমানে দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ১৩২টি। যা প্রতিবন্ধীদের সংখ্যার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তাই দেশের প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। যেসব হতদরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী রয়েছে এমন পরিবারগুলোয় আয়বর্ধনমূলক সহযোগিতা দেয়া প্রয়োজন, যাতে তারা দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই প্রতিবন্ধীদের অক্ষমতা না দেখে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে হবে। তারা বোঝা নয় বরং সহযোগিতা পেলে তারাও দেশের সম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে।