একজন মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। একজন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করা। তাহলে সে শিক্ষাটা অবশ্যই হতে হবে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং-বাণিজ্য মহামারী আকার ধারণ করেছে। দেশজুড়ে চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, এমনকি থানা শহরেও রয়েছে এর শাখা ও প্রশাখার বিস্তার। সারাদেশে বড় ও ছোট মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ কোচিং সেন্টার রয়েছে। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না শিক্ষা ধ্বংসের এই আত্মঘাতী প্রবণতা। কোচিং বন্ধের নীতিমালা থাকার পরও তদারকির অভাবে গত সাড়ে ৬ বছরে তা কেবলই কাগুজে নীতিমালায় পরিণত হয়েছে। স্কুল ও কলেজের একশ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষক লাগামহীন কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষায় নম্বর কম দিয়ে, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে, বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে এ শ্রেণির শিক্ষকরা তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের পড়তে বাধ্য করছেন। এমনকি এ থেকে বাদ যাচ্ছে না প্রাথমিক স্তরের কোমলমতি শিশুরাও। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী যাচ্ছে কোচিং সেন্টারে। কিন্তু বাস্তবে এই শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিশেষ প্রয়োজনে প্রাইভেট-কোচিং প্রচলিত হয়েছিল। সময়ের পরিবর্তনে নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাইভেট বা কোচিংয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে এমনটি মনে করা হয়েছিলো। কিন্তু তা না হয়ে কোচিং নামের এই বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো, যা কিনা দগ্ধ করে দিচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। ২০১১ সালের উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ দেওয়ার ঠিক পরের বছরই একটি নীতিমালা জারি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটি ছিল শিক্ষকদের ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা নিয়ে। এটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ ঐ বছরের ২০ জুন এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা হয়। কিন্তু নীতিমালা জারির ১১ বছর পর ২০২৩-এ এসে দেখা গেল, মাঠ পর্যায়ে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের হার শূন্য ভাগ,নেই কোনো মনিটরিং কার্যক্রমও। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তরকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চালু করেছে সরকার। এ অবস্থায় বাস্তবতা হলো, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রাইভেট-বাণিজ্য বা কোচিং-বাণিজ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন ভুক্তভোগী অভিভাবকরা। কোমলমতি শিশুদের কাছে স্কুলের মুক্ত আঙিনাকে আনন্দময় করার বদলে স্কুলকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা হচ্ছে দিন দিন। তাই এখনি নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ। একবারে সারাদেশের কোচিং বন্ধ করা সম্ভব নয় তাই কোচিংকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। অতি দ্রুত বাংলাদেশের সব স্কুল, কলেজ-ভিত্তিক কোচিং বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি স্কুল ও কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আরও অধিক নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আর তাহলেই এই কোচিং নামের এই ভাইরাস থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে।