প্রতিদিনই ভূমিম্পের আতঙ্কে কাটে প্রহর। চীনে ভয়াবহ ভূমিকম্পে শতাধিক নিহতের ঘটনায় আরো আতঙ্ক বেড়েছে। একজন সচেতন নাগরিক-সমাজকর্মী ও লেখক হিসেবে ভূমিকম্প নিয়ে আমার প্রচুর জানার সুযোগ হয়েছে ভূমিকম্প প্রবণতার কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে জানার। সেই আলোকে যখন জানতে পারি- সারা বিশে^ শুরু হয়েছে ভূমিকম্পের ধারাবাহিক ঘটনা ঘটতে থাকবে, ব্যথিত হই। এমনই এক ভূমিকম্পে মরক্কোতে নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছিলো, অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছিলো। মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পটি শুক্রবার রাতে আঘাত হেনেছিলো। মরক্কোর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পেরেছি- ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভেও তথ্যে- ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মারাক্কেশ শহর থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরে এটলাস পর্বতমালা এলাকার ১৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার গভীরে। শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১১.১১ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানার পর লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ভূমিকম্পটির ১৯ মিনিট পর আবারো ৪ দশমিক ৯ মাত্রার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের ভিডিও দেখা যাচ্ছিলো।
এই ভূমিকম্প সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলোর একটি, একথা যেমন সত্য, তেমন সত্য মরক্কোর ওই এলাকার মাটির নীচে থাকা অ্যারাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে গিয়ে আনাতোলিয়ান প্লেটে ধাক্কা দিলে এই ভয়াবহ ভূমিকম্পের তৈরি হয়। একই কারণে ১৮২২ সালেও এখানেই একদফা ভূমিকম্প হয়েছিল। বিশ্বের যেসব এলাকা ভূমিকম্প প্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তুরস্কের এই এলাকাটি তার অন্যতম। ভূতত্ত্ববিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক পরিচালক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘’পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোন বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্টে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। বিজ্ঞানীদের মতে- প্লেট বাউন্ডারি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমরা বলি ফল্টলাইন। এর আশেপাশের দেশগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে। বিশ্বের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে জাতিসংঘ গ্লোবাল সিসমিক হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রাম নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছিল। সেটার উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি মানচিত্র তৈরি করা, যাতে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে। সেই প্রকল্পের আওতায় অতীতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের তথ্য এবং গবেষণার ভিত্তিতে বিশ্বকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বের যেসব এলাকা বিজ্ঞানীদের বিশেষ নজরে রয়েছে।
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে- বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। আরেকটু গভীর দৃষ্টিতে জানার চেষ্টা করতেই উঠে এসেছে আরো আশঙ্কাজনক তথ্য- বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এরকম মোটামুটি ৫টি চ্যুতি (ফল্ট) আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মরক্কো-তুরস্ক-সিরিয়ার মতো বাংলাদেশও ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। আমাদের এখানে মোটামুটি ৫টি ফল্ট লাইন আছে। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের একটি ফল্ট লাইনে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২-৩টি ফল্ট লাইন আছে। দেশের ভেতরেও বঙ্গবন্ধু সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালীতে এরকম ফল্ট লাইন আছে। এমতবস্থায় আমরা চাই এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ সচেতনতার সাথে। সকল রকম ভারি উন্নয়ন কর্ম সুপরিকল্পনার সাথে হাতে নেয়ার আহবান জানাচ্ছি। তা না হলে কিন্তু ভয়ংকরভাবে উচ্চারিত হতে পারে আবারো এমন কথা-'আমাদের এখানেও ঐতিহাসিকভাবে ১৮৭০ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তুরস্কের মতো বা এর চেয়ে বড় ধরনের, যেমন- ৭ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তুরস্কের ভূমিকম্পগুলোকে সে তুলনায় ছোটই বলা যায়। ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড ধরা হয় ১৫০-২৫০ বছর। ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সাইকেল হিসেবে সেটি এখনো ফিরে আসেনি। এরপর ১৮৮৫ সালে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা হয়ত আরও ১০-২০ বছর পর হতে পারে। এরকম ১৫০-২৫০ বছরের যে সাইকেল আছে, সেটি কখন হবে কেউ জানে না। ফলে তুরস্কও ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করতে পারেনি। আসলে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান করা সম্ভব না। তবে ব্যবস্থা একটাই, প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রস্তুতি না নিলে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে। যা আমাদের কারোই কাম্য নয়, আর এ কারণেই বিশেষজ্ঞদের তথ্যগুলো মনে রাখতে হবে- এ ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্টকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে ৯৯ শতাংশ নতুন ভবন টিকে যায়। তবে পুরনো ভবনের জন্য মজবুতিকরণ পন্থায় যেতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- তুরস্ক আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। তারা ভূমিকম্প আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্গত এলাকায় তল্লাশি ও উদ্ধারকারী বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছে, হেলিকপ্টারে করে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। তুরস্কের সব ভবন তো আর ভালো নয়, যেগুলো ভেঙেছে সেগুলোর বেশিরভাগই ২-৩ তলার, তবে আশপাশে বহুতল ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। একজন ভূতত্ববিদ ভূমিকম্প প্রসঙ্গে বলেছেন- আমাদের রেসপন্ডিং ক্যাপাসিটি কতটুকু সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কেননা এক রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজ চালাতেই আমাদের ১৫ দিন লেগে গেছে। এরকম একাধিক ভবন যদি বিধ্বস্ত হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, একটি ভূমিকম্প না হলে আমরা নিজেদের যাচাই করতে পারব না; অতএব ফায়ার সার্ভিস যাতে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের অফিসে কিছু সরঞ্জাম রেখে দেয়। কারণ আমাদের শহরগুলোতে শুধু চিপা গলি আর গলি, তুরস্ক ও সিরিয়ার রাস্তাঘাট কিন্তু এমন না, বেশ চওড়া এবং সহজেই যেকোনো জায়গায় পৌঁছানো যায়। আমাদের পুরান ঢাকায় যদি ভূমিকম্প হয়, দেখা যাবে কোনো গাড়িই সেখানে ঢুকতে পারবে না। সে কারণে স্থানীয় কমিউনিটিকে ক্ষমতায়ন করে কিছু সরঞ্জাম তাদের কাছে রেখে দিলে এবং নিয়মিত চর্চা করলে ভালো হতো। নইলে এই ইস্যুগুলো আমাদের জন্য একসময় কাল হয়ে দাঁড়াবে।
আরেকটি শঙ্কার বিষয় হলো- আমাদের এখানে বিল্ডিং কোড সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, এটাও একটা বড় ইস্যু। ১৯৯৬ সাল থেকে যেহেতু আমাদের বিল্ডিং কোড আছে, সেহেতু এই সময়ের পর থেকে নির্মিত বহুতল ভবনগুলো ভালো অবস্থায় থাকবে বলে বিশ্বাস করি। তবে আমাদের পুরনো ২-৩ বা ৫ তলার যেসব ভবন আছে, যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো যদি বিধ্বস্ত হয়, সেক্ষেত্রে প্রথমত এখনই সেগুলোকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, উদ্ধারকাজের জন্য নিয়মিত কিছু মহড়া করে করে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। একই সাথে জানা প্রয়োজন-কোনো স্থানের ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইন এবং টেকনিক স্ট্রেস ফিল্ড গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণত, বড় ধরনের ভূকম্পন হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে নয়, তথাপি ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান ও বিন্যাসের স্বকীয়তা বাংলাদেশকে ভূমিকম্প মণ্ডলের আশপাশেই ফেলেছে। বাংলাদেশকে ভূকম্পনের তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন হিসেবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছুকিছু স্থান যেমন: সিলেট, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার উল্লেখযোগ্য। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত। ১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যতবার পাঁচ বা তার বেশি মাত্রায় ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, তার প্রায় সব কটির উৎপত্তিস্থল সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায়। এসব অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরও বেশি মাত্রার ভূকম্পনের পূর্বাভাস উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসাম-বাংলা অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, মেঘালয়ের সীমান্তসংলগ্ন সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর,ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জেলাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা বিভাগের মধ্যে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী জেলার অংশ বিশেষ, পুরো কিশোরগঞ্জ জেলা এবং কুমিল্লা বিভাগের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উত্তরাংশ।
আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে ভূমিকম্পের বিষয়ে। সচেতন থাকতে হবে ভূমিকম্পের বিষয়ে। একই সাথে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে মনে রাখতে হবে- বড় বড় উন্নয়ন অবকাঠামো মানেই ভূমিকম্পের প্রবণতা বৃদ্ধি করা। দেশকে-দেশের মানুষকে কষ্টের-ঝুঁকির মুখোমুখি রাখা। সচেতনতা তৈরি হোক, সচেতন থাকুন সবাই... (লেখক: চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি)