আমাদের দেশ ষড় ঋতুর দেশ। দুই মাস পরপর ঋতুর বদল হয়। ঋতু বদলের পালাক্রমে প্রকৃতির মাঝে অপরূপ পরিবর্তন আসে। প্রকৃতির পরিবর্তনে, পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে। প্রকৃতির সাথে সাথে পরিবর্তন আসে সংস্কৃতি ও সভ্যতায়। সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিক স্রোতে পরিবর্তন এসেছে সমাজ জীবনে। এখানে আদিকাল থেকে লোকবসতি ছিল। ছিল কৃষ্টি, কালচার, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। প্রাচীনকাল থেকে এখানের সংরক্ষণ, সনাতন সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি বা গ্রাম্য সংস্কৃতি মানুষের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। স্বাধীনতার আগে ও পরে লোকসংস্কৃতি ব্যাপকভাবে পরিচর্চা করা হতো। শহর, নগর, গ্রামে, পাড়া, মহল্লায়, বাসাবাড়িতে লোকসংস্কৃতি, বাউল গীতি, আঞ্চলিক গান, মানিক পীরের গান, বাসান গান, নাট্যচর্চা ইত্যাদির আসর বসত। সামাজিক জীবনে, নানা উৎসব ও আয়োজনে জারিসারি, ভাটিয়ালি, ভাব গান, পুঁথিপাঠ, গাজী গীত যথাযথভাবে পালিত হতো। মাঠে-ময়দানে, চাষি, মজুর, রাখাল ছেলেরা গলা খুলে প্রাণ ভরে ভাটিয়ালি গান মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। গাঁয়ের গাড়িয়াল, নদীতে মাঝি, খোলা মাঠে রাখাল, কৃষক চাষি সবাই ভাটিয়ালি গানের গায়ক ছিল। তাদের মুখে গানের সুর দ্যুতি ছড়িয়ে দিত চার দিকে। ভাটিয়ালি গান সবাই মন প্রাণ ভরে শুনত। ভরে উঠত সবার হৃদয় প্রাণ। ভাটিয়ালির পাশাপাশি, লোকসংস্কৃতিতে পালা বা যাত্রা গান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। পালা বা যাত্রা গান শীত মওসুমে গ্রাম্য অঞ্চলে বিরাট বিরাট আসর বসত। শুধু গ্রামে নয়, অনেক সময় শহরের কেন্দ্রস্থলে পালা বা যাত্রা গানের আসর হতো। পালা বা যাত্রা গান শুনতে নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে সবাই আসত। সমাজে এসব সংস্কৃতি ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিসহ এক শ্রেণীর সমাজপতির বিদ্রুপাক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নানারূপ বাধা সৃষ্টি করত। সব বাধা মোকাবেলা করে লোক বা গ্রাম্য সংস্কৃতি যথাযথভাবে পালন করা হতো। তবে কালের আবর্তন বিবর্তনে, সময়ের পরিবর্তনে সমাজের সাংস্কৃতিক দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেছে সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপট। বর্তমান আধুনিকতার পালা বদলে হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতি। কিন্তু বর্তমান আধুনিক যুগে বেশির ভাগ মানুষের ঘরে বিনোদনের বস্তু হিসেবে টেলিভিশনের সুব্যবস্থা রয়েছে। টেলিভিশনের মাধ্যমে সবাই বিনোদন করে থাকে। তাই তো সেই প্রেক্ষাপটের আলো সমাজ থেকে পালা বা যাত্রা গান ক্রমান্বয়ে হারাতে বসেছে। লোক সংস্কৃতির অংশ হিসাবে পুতুল নাচ একটি আনন্দ দায়ক খেলা। এটি শিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। গ্রামে যখন সার্কাস আসত, তখন পুতুল নাচ খেলার আয়োজন করা হতো। শুধু যে শিশুরাই পুতুল নাচ খেলা দেখত তা কিন্তু নয়। এই মজার খেলাটি উপভোগ করার জন্য শিশুদের পাশাপাশি নারী-পুরুষ উভয় দলেই মজা করে খেলা দেখত। তবে এখন আর পুতুল খেলা নেই। এখন জ্যান্ত পুতুলেরা নেচে মানুষকে বিপুল খোরাক জোগাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় লোকসংস্কৃতি হারাতে বসেছে। আধুনিকতার যুগে একটু সচেতন হলেই আমরা লোকসংস্কৃতিকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারি। গ্রাম বাংলার হাজারো মানুষের প্রাণ প্রিয় লোক সংস্কৃতিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন। কোথায় সেই চিরচেনা সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি নিয়ে দেশ বরেণ্য কবি-সাহিত্যক, লেখক, নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণসহ কবিতা লিখা রয়েছে, সেই সাথে বহু বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি হল দেশের প্রাণ। আর সেই প্রাণ যদি বিলুপ্তির পথে যায়, তাহলে সে দেশে বসবাস অযোগ্য হয়ে যাওয়ার মতো। তাই দেশের ফুসফুস খ্যাত লোকসংস্কৃতি রক্ষায় দেশ ও বাঙালি জাঁতি তৎপর হতে হবে। নিজের দেশের সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের। নিজ-সংস্কৃতি রক্ষার্থে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব জাতির নিজেরই। গবেষক, শিল্পী, পৃষ্ঠপোষক এবং অবশ্যই শ্রোতামহল সহ সকলকেই এ ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা তো প্রয়োজনীয় বটেই, কিন্তু সব থেকে যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা হলো বর্তমানের শিল্পীদের বাংলা তথা বাঙালি শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা। কারণ হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন শিল্পী, কলাকৌশলী, শুভান্যুধায়ী। দেশের উন্নয়নে আধুনিকায়নের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া কাম্য নয়। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় সজাগ হতে হবে। বিশ্বায়নের স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে হারিয়ে ফেলা যাবে না আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বাঁচতে পারে আমাদের চির-পরিচিত লোকসংস্কৃতি। এরজন্য গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। লোকসংস্কৃতির প্রয়োজন আছে তা বোঝাতে হবে। যে সকল দারিদ্র্য লোকজন বাঙালির আদি সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় তাদের কে পৃষ্টপোষকতার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। সংস্কৃতি আমাদের তাই রক্ষা করার দায়ভারও আমাদেরকেই নিতে হবে।