সম্প্রতি কর্মজীবী এক মায়ের গল্প নিয়ে নির্মিত নাটক সুপার হিট করেছে! জনপ্রিয় তো সেটাই হয় যেটা জীবনের সাথে মিলে যায়! মাতৃত্বের অনুভূতি সুখের কিন্তু কর্মজীবী মায়েদের জন্য ততোটা নয়! পুরুষের খোলস থেকে বের হয়ে মানুষ হিসেবে বিচার করলে, সন্তানের ওপর পিতার দাবি সিকি শতাংশ হওয়া উচিত! সন্তান পঁচিশবার মা মা ডাকার পরে একবার বাবা ডাকলেই পিতার সন্তুষ্ট থাকা উচিত! সন্তানকে নিয়ে পিতার পরিশ্রম কী তার অধিক?
এমন শীতের মধ্যরাতে জেগে জেগে সন্তানকে পাহারা দেয়া, বারকয়েক খাওয়ানো, বালিশে ঠিকঠাক আছে কিনা, কাঁথা ভিজিয়েছে কিনা সেটা চেক করা-এসবের মর্ম পুরুষ বোঝেনি বোধহয়! বরং গলা চড়িয়ে বলতে পেরেছে, ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে, পাশের রূমে গিয়ে ঘুমাও! সন্তানের প্রস্রাব/পায়খানায় নষ্ট হওয়া কাপড়/কাঁথা পুরুষ দু'বার ধুয়েছে-দৃষ্টান্তের জন্য ইতিহাস খুঁজতে হবে! ট্যা ট্যা করে ক্ষাণিকক্ষণ কাঁদলেই তাকে থামানোর দায় মায়ের ওপরেই বর্তায়! বাবা হিসেবে বড় বড় বাতেলা দেয়া ছাড়া বাবাত্বের আর কোন কোন ঋণ পুরুষ শোধ করেছে তা কে জানে!
বাংলাদেশের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে নারী বাড়তি সুযোগ পায় না! তার ওপরে যদি শোনে মা হয়েছে তবে অন্য মায়ের সন্তানেরা আরও বেশি কাজ চাপায়! সন্তান-সংসার এবং কর্মক্ষেত্র সামলানোর সীমাহীন দ্বন্দ্বে মানসিক বহুরোগ ভর করে। একদিকে সন্তানকে সময় দেয়ায় কমতি হচ্ছে, আরেকদিকে দায়িত্বের পরিধিকে সামলাতে গিয়ে নারী অন্তরদ্বন্দ্বে ভোগে! অধিকন্তু যদি স্বামী সাপোর্টিভ না হয়, পরিবার সহমর্মিতা না দেখায়, কলিগ আন্তরিক না হয় তবে সে মায়ের দুঃখ কোথায় রাখি!
কর্মজীবী মায়েদের সংগ্রাম কাছ থেকে না দেখলে উপলব্ধি করা অসম্ভব। মায়েদের একেকটা রাত্রের গল্প বহুমাত্রিক সিনেমা। নিজের শখ, পতির আব্দার, সন্তানের ক্ষুধা-পাগল পাগল একটা অবস্থার সৃষ্টি করে! এরপরে যদি হয় সংসারে একা তবে তো সসীমের মাঝেও অসীম যন্ত্রণা! যৌথ পরিবারগুলোতে চাচী/ফুফুদের কোলে কোলে সন্তান কবে বড় হয়ে যেত মা তার খবরও পেত না! সেই পরিবার কারা ষড়যন্ত্র করে ভেঙেছিল সে বিতর্ক আরেকদিন হবে!
কর্মজীবী মায়েদের যে সাপোর্ট দরকার তা আমাদের মানসিকতায় নাই! বাবাত্বের প্রশ্নে পুরুষ এখনো পূর্ণ মানুষ হতে পারেনি! তাদের মধ্যে এখনো প্রভূ প্রভূ ভাব! অফিসের বসেরও এখনো সে বুঝ আসেনি-সেও এক মায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। মায়ের এমন হ্যাসেল দেখতে দেখতে সন্তানও সেই খাসিয়ত নিয়ে বেড়ে ওঠে! এক সময়ে মায়ের ঋণ ভুলে যায়! এই সমাজের সন্তানেরা এখনো মায়ের রোগের কথা শুনে যতোটা বিচলিত হয় তার অধিক দুশ্চিন্তা করে বাবার অসুস্থতা নিয়ে। মেয়ে-ছেলে নির্বিশেষে!
কর্মজীবী মায়েদের ছুটি অন্তত এক বছর করা উচিত। সমগ্র কর্মজীবীনে দু'টো বছরের ছুটিতে রাস্ট্রের/সংঘের তেমন কোন ক্ষতি হবে না তবে সন্তান-মায়ের ব্যাপক উপকার হবে। প্রথম ০৬ মাস বেতনসহ ছুটি এবং পরের ছয় মাসে বেতনের কাটছাট হতে পারে। দুই বছর অবধি মায়েদের অফিস আওয়ারের সংকোচন দরকার যাতে নিয়মিত শিশুখাদ্য থেকে সন্তানকে বঞ্চিত হতে না হয়। রাস্ট্র এটুকু ভাবতে পারে। দিন দিন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কাজেই কর্মজীবী মায়েদেরকে রাস্ট্রের বৃহত্তম স্বার্থে আলাদা চোখে দেখা উচিত।
পুরুষ আরেকটু মানুষ হোক। ভালো বাবা হোক। সেজন্য নিজ সন্তানের মায়ের ভরসা হতে হবে, মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে, কায়িক সাহায্য করতে হবে। দু'বেলা ভাত রাঁধলে, কয়েকদিন এঁটো থালাবাসন পরিস্কার করলে, দু'দিন ঘর মুছলে পুরুষের জাত যাবে না। একজন ভালো বাবা হওয়ার জন্য, একজন আদর্শ পতি হওয়ার জন্য জায়ার দরদী হতে হবে। সন্তানের দেখভাল করতে হবে। কেবল ক্ষুধার প্রয়োজন মেটানো এবং নিরাপত্তা দিয়ে পুরুষ হওয়া যায় কিন্তু বাবা হতে হলে বাড়তি কিছু করতেই হবে। রাত জেগে সন্তানকে কাঁধে নিয়ে ফ্লোরে ফ্লোরে হাঁটতে হবে। মনে রাখতে হবে, বউটিও মানুষ এবং সন্তানটিও নিজের। (রাজু আহমেদ, কলাম লেখক)