মানবজীবনের সাথে সবচেয়ে ভালো তুলনা চলে একটি ফুলের জীবনচক্রের। যতদিন সুঘ্রাণ থাকে ভ্রমর আসে, পথিক বিমোহিত হয়, পরিবেশের শোভা বাড়ায়। ফুলে যতদিন মধু থাকে মৌমাছির দল উড়ে উড়ে মধু পান করে। অতঃপর একদিন বৃক্ষ থেকে ফুল ঝরে গেলে কিংবা ঘ্রাণ হারিয়ে শুকিয়ে গেলে পথিক মনে রাখে না, ভ্রমর ছুটে আসে না কিংবা মৌমাছিও স্পর্শ করে না। মানবজীবন কি এর ব্যতিক্রম? সেবা কিংবা স্বার্থের প্রশ্নে মানুষ মানুষকে এভাবেই মনে রাখে। কাজেই ক্ষণিকের জীবনে যতবেশি পালক ছড়ানো যায়, জ্যোতি বাড়ানো যায়, পরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়া যায় ততবেশি স্বার্থকতা। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোটে না, তেমনি মানুষেরও কেবল নিজের জন্য বাঁচা ঠিক নয়। পরের তরে কিছু করতে গেলে কিছুকিছু ভুল হতে পারে কিন্তু থেমে গেলে জীবন স্থবির হয়ে যাবে। যারা কেবল নিজের জন্য ভাবে, নিজেকে ঘিরে বাঁচে তারা ফুলের জীবন পেলেও সে ফুলে সুঘ্রাণ নাই। মৌমাছি আকর্ষণ করার মত মধু নাই। গল্পণ্ডকবিতায় স্থান পাওয়ার যোগ্য জাদুও নাই। যে জীবন অপরের জন্য কিছু করে না, মানবিকতার হাত বাড়ায় না, কারো দুঃখ দেখে কাঁদে না, কারো কাঁধে ভরসার হাত রাখে না সে জীবন গড়পড়তার জীবন। বকুলের মত শুঁকিয়ে গেলেও কারো বুক পকেটে, কারো বেণীতে, কারো বইয়ের ভাঁজে থাকতে হলে জীবনের থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে হবে। গাছকাটা গোলাপ থেকে ফুলের তোড়ন হতে হলে, রুমের সৌন্দর্য বাড়াতে ফুলদানিতে জায়গা পেতে হলে, প্রেমের প্রতীক হতে হলে জীবনের সৌন্দর্য বাড়াতে হবে। রূপে নয় ; বৈচিত্র্যে। বিকশিত মানবজীবন ফুলের চেয়েও দামী যদি সে মন যত্ন পায়। একটু পরিচর্যায় জীবন রত্ন ফলাতে পারে। ব্যক্তিত্বকে আকর্ষণীয় করতে হলে, অপরের কাছে গ্রহনযোগ্য করতে গেলে সদালাপী-সত্যবাদী হতে হবে। সততা-বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরোপকারী-মানবহিতৈষী মহাজন হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে হবে। স্বার্থহীন-স্বচ্চরিত্রবান সত্ত্বায় উন্নীত হতে হবে। যে পুষ্পের ক্ষত আছে সে ফুল যেমন বৃক্ষের বোঝা, পথিকের চোখের বিষ তেমনি যে মানুষ মানসিকতায় অসুস্থ, চিন্তায় বিকলাঙ্গ সে মানুষ সভ্য সমাজের উৎপাত। সবার অপছন্দ হয়ে বেঁচে থাকার মাঝে, বিচরণের মাঝে স্বার্থকতা নাই বরং অস্বস্তি। যারা সমাজ অসুস্থ রাখে তারা হয়তো উপলব্ধি করে না কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে কিন্তু তাদেকে পছন্দ করে, ভালোবাসে সে সংখ্যা এখানে শুন্য। এই বিশাল পৃথিবীতে ভালোবাসাহীন বাঁচা ঠিক নয়। কার মধ্যে খারাবি নাই? তবে আত্মচেষ্টায় কেবল ভালোটুকু প্রকাশ-প্রচার করা যায়। মন্দকে যদি দমিয়ে রাখা না যায় তবে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ বৃথাই গেল। মানুষ পাশবিক হলে, অমানবিক হলে, বর্বর হলে বিবেকহীন জানোয়ারের সাথে তফাৎ কোথায়? মানবাত্মা পবিত্র হোক, বিবেকের শানিত বোধে জীবনযাত্রা নির্বিঘ্ন হোক। জীবনে কেবল নিজের ভালো থাকাই শ্রেয়তর নয় বরং আরও কতগুলো মানুষকে ভালো রাখা যায়, কত মানুষের ভরসা হওয়া যায়, আর কার কার বিশ্বাস বাঁচানো যায় সে প্রচেষ্টা প্রলম্বিত হোক। কারো ক্ষতি করে, কাউকে বিপদে ফেলে এবং কারো বিরক্তির কারণ হয়ে মহৎজীবনের অংশীজন হওয়া যায় না। মানুষের জীবন হোক সুবাসিত ফুল। দূরে থাক সব অযাচিত ভুল। (রাজু আহমেদ, কলাম লেখক)