‘নয় মাস ধরে যুদ্ধ করে রাত-দুপুরের বীর
জাগিয়ে রাখে রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের শীর
ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ আসলো বিজয় হেসে
হাসলো আবার সুখে হাসি মা যে বাংলাদেশে...’
এই লেখাটি বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিলো গত ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক যায়যায়দিনে। আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর এমন নিবেদিত কাব্য তাকে উৎসর্গ করছি। একই সাথে তাঁর কাছে ছাত্র-যুব-জনতার পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি- দয়া করে রাজনীতিকে পরিবারতন্ত্রের হাত থেকে মুক্ত করুন, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে ‘মূল্য নির্ধারণ কমিশন’ গঠন এবং কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পুলিশ-প্রশাসনকে সক্রিয় করুন, সেই সাথে অর্থপাঁচার রোধে ‘দুদক’কে স্বাধীন এবং শক্তিশালী করার ব্যবস্থা করুন। যদি দেশ এগিয়ে যায় অর্থনৈতিকভাবে, তাহলে আপনার এই টানা ৪ বারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড যেমন স্বার্থক হবে, তেমনই উজ্জ্বল হবে বাংলাদেশের আগামী।
এখন আসি সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমের মানুষ হিসেবে ভালোবাসার বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে আলোকপাতে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের মাধ্যমে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। আর শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন বিশ্বরাজনীতিতে। বিশ্বে শেখ হাসিনাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন নারী সরকারপ্রধান। এরই মধ্যে চার মেয়াদে ২০ বছর সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নানা শঙ্কা, আতঙ্ক ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গতকাল রবিবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে রাত ২টা পর্যন্ত পাওয়া খবরে আওয়ামী লীগ ২২৩, স্বতন্ত্র ৫৬, জাতীয় পার্টি ১১, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে বিজয়ী হয়েছে। ময়মনসিংহ-৩ আসনে ফলাফল স্থগিত রাখা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করায় আওয়ামী লীগের জয় ও পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন অনেকটা নিশ্চিত থাকলেও নির্বাচনকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে দেশব্যাপী অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতার কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে সংশয়ও দেখা দেয়। তবে তুলনামূলক কিছুটা কম ভোটার উপস্থিতি, কয়েকটি আসনে গোলযোগ ও অনিয়মের অভিযোগ ছাড়া মোটাদাগে শান্তিপূর্ণভাবেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
একটু ইতিহাসেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। সেই ইতিহাসে দেখা যায়- স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এরপর দীর্ঘ সামরিক শাসন শেষে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। কিন্তু ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসনে বসে। এরপর ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের জয়যাত্রা শুরু হয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই হিসাবে ২০০৮ সালের পর থেকে টানা চতুর্থবার এবং ১৯৭৩ সাল থেকে মোট ষষ্ঠবার সরকার গঠন করে রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী চরিত্র অনুযায়ী- চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা হবে। এরপরই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করবেন। তারপরই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার শপথগ্রহণ করবে। নির্বাচনে শেখ হাসিনা তাঁর পিতৃভূমি গোপালগঞ্জ-৩ (টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া) আসন থেকে আবারও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এ নিয়ে এই আসন থেকে অষ্টমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন।
আরো একটা বিষয় তুলে ধরতে চাই- নির্বাচনকে কতটা ভালোবাসেন শেখ হাসিনা, তার প্রমাণ পাওয়া যায়- তিনি ৭টা ৫৫ মিনিটে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিককে নিয়ে রাজধানীর সিটি কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। ঢাকা-১০ আসনে নৌকার প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদ তাঁদের স্বাগত জানান। ভোট দেওয়ার পর তিনি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই দেশের উন্নতি হয়েছে। আমাদের সামনে আরো কাজ আছে, এগুলো সম্পন্ন করতে চাই। জনগণের ওপর আমার আস্থা আছে।’
অবশ্য শঙ্কার এই নির্বাচন নিয়ে অনেকে অনেক কথা ভাবলেও এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাঁর মতে- এবারের নির্বাচনে ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। নির্বাচনে গুরুতর সহিংসতা হয়নি। যেখানে অনিয়ম হয়েছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতিই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সেই চ্যালেঞ্জে অনেকটা জয়ী বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমনকি নানা আশঙ্কা ও আতঙ্ক থাকলেও সফলভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে বলে ইসি দাবি করেছে। কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ভোট বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন।
এবার ২৯৯ আসনে ভোট হয়েছে। রাত ২টা পর্যন্ত ২৯৯ আসনের অনানুষ্ঠানিক ফল পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে ২২৩টিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনে ৬৩টি আসনে জয়ী হয়ে নতুন চমক সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ১১টি আসনে, ওয়ার্কার্স পার্টি ১ ও কল্যাণ পার্টি ১টি আসন পেয়েছে। জয়ের সংখ্যা হিসাবে আওয়ামী লীগের পর স্বতন্ত্রদের অবস্থান। জাতীয় পার্টি তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে দলগত বিবেচনায় জাতীয় পার্টি দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপিসহ ১৬টি রাজনৈতিক দল বর্জন করে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিসহ অংশ নেয় ২৮টি দল। এই ২৮ টি দল প্রসঙ্গে একটু বলতে চাই- আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়ায় এই নির্বাচনের চেয়ে বেশি চেয়েছিলাম অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার দিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য মনোনীবেশ করার বিষয়ে। সেই দিকে দৃষ্টি না দেয়ায়, আমি একজন রাজপথের সক্রিয় ব্যক্তি হওয়া স্বত্বেও এই নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থেকেছি। কিন্তু তথাকথিত কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দল নিজেদের অতিত ইতিহাসের মত ডিগবাজী দিয়ে এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়। এরা কখনো নিজেদের ভিত্তি শক্ত করার চিন্তা করেনি। বরং নির্বাচন এলে নির্বাচন নির্বাচন খেলায় অংশ নিয়ে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত হয়ে যায়। এই দলগুলোর আলোচনা করতে গেলে লোভের কথা উঠে আসে সবার আগে। কি করেছে তারা? কতটা জনসম্পৃক্ততা আছে তাদের? এমন প্রশ্নের পথ ধরে দেখা যায়- দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তার মধ্যে বেসরকারিভাবে ঘোষিত ২৯৮টি আসনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র ৫টি দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। বাকি ২৩টি দলের কোনো প্রার্থী জয় পাননি। বরং তাদের ৯১% প্রার্থীর জামানত বাতিল হয়েছে। যে দলগুলোর প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, সেগুলো হলো-আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), কল্যাণ পার্টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলো মাত্র ১টি করে আসনে জয়ী হয়েছে। বাকি দলগুলো কি অবস্থা তা জানতে চলুন এগিয়ে যাই- দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ ৩৯টি আসনে, ইসলামী ঐক্যজোট ৪২টি আসনে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৩০টি আসনে, গণফোরাম ৯টি আসনে, গণফ্রন্ট ২১টি আসনে, জাকের পার্টি ২১টি আসনে, জাতীয় পার্টি ২৬৫টি আসনে, জাতীয় পার্টি-জেপি ১৩টি আসনে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ৬৬টি আসনে, তৃণমূল বিএনপি ১৩৫টি আসনে, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ১২২টি আসনে, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ ১০টি আসনে, আওয়ামী লীগ ২৬৬টি আসনে, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৩৭টি আসনে, বাংলাদেশ কংগ্রেস ৯৬টি আসনে, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১৬টি আসনে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ১১টি আসনে, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ৫টি আসনে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ৫৬টি আসনে, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ৩৮টি আসনে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ৫টি আসনে, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট ৪৫টি আসনে, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪টি আসনে, সুপ্রিম পার্টি ৭৯টি আসনে, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ৬৩টি আসনে, ওয়ার্কার্স পার্টি ২৬টি আসনে, সাম্যবাদী দল ৪টি আসনে ও গণতন্ত্রী পার্টি ১০টি আসনে প্রার্থী দেয়। এদের জামানত তো হারিয়েছেই, রাজনীতির সম্মানও ক্ষুন্ন করেছে। অতএব, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি সর্বাত্মক দাবি জানাচ্ছি ছাত্র-যুব-জনতার সাথে সম্পৃক্ততাহীন ২৩ টি এবং নির্বাচনে অংশ না নেয়া বিএনপি, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, সিপিবি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশ, ইনসানিয়াত বিপ্লব, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা এনডিএম, বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, জেএসডি (রব), বাসদ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (হারিকেন), গণফোরাম এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপসহ মোট ৪১ টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করে রাজপথে থাকা সক্রিয় রাজনৈতিক প্লাটফর্মগুলোর নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। (মোমিন মেহেদী : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস)