সেভ দ্য রোড-এর মহাসচিব হিসেবে বরাবরই ছিলাম মানুষের জন্য নিবেদিত পথ ও পরিবহনের দাবিতে সোচ্চার। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর ধরে সেভ দ্য রোড আলোর জন্য-ভালোর জন্য নিরন্তর রাজপথে ছিলো, আগামীতেও থাকবে। নির্মম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। যেখানে নিয়ম করে রাজপথে অবরোধ-হরতাল আর সহিংসতাকে জনগণের কাঁধের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে ছাত্র-যুব-কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতা বিরোধী-দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিকচক্র। এই চক্রের কারণে দুর্বৃত্তদের হামলা বাড়ছে, বাড়ছে একশ্রেণির পুলিশ-প্রশাসনের অসাধু কর্মকতা-কর্মচারিদের দৌড়াত্ম। আর এতে করে সাধারণ মানুষ ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছে। গত ৭২ দিনে ৫০৫ বাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। আর এই অগ্নিসংযোগে নিহত হয়েছেন ১২ জন, আহত হয়েছেন ৬৪৩ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৮৪৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। গত ২৮ অক্টোবর থেকে সারাদেশে সহিংসতার রাজনীতি দানা বেঁধে উঠেছে। সেভ দ্য রোড-এর গবেষণা সেল-এর তত্বাবধায়নে ২২ টি জাতীয় দৈনিক, ১১ টি ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যম, ২৪ টি নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং প্রত্যক্ষদর্শী- স্বেচ্ছাসেবিদের তথ্যানুযায়ী গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭২ দিনে দূর্বৃত্তদের রাজনীতির নামে মানুষকে কষ্টে বেদনায় আক্রান্ত করার সহিংসতায় ৫০৫ টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮৭ টি বাসসহ বিভিন্ন পরিবহণ এবং ১৮ ট্রেনের বগি। ২৮ অক্টোবরই প্রথম রেলওয়ের বগিতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। শুধু এখানেই শেষ নয়, মা ও সন্তান একসাথে মোহনগঞ্জ এক্সেপ্রেসে নির্মম আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে এই দুর্বৃত্তদের আগুনে। এই অগ্নিসংযোগকারীদের আগুন থেকে রেহাই না পেয়ে স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আত্মাহুতি দিয়েছেন একজন পিতা। একই সাথে অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। চন্দ্রিকা চৌধুরী নামে এক শিক্ষার্থীকে এখনো খুঁজে পায়নি তাঁর পরিবার। কিন্তু এত এত নির্মম ঘটনার একটিও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি এখনো। হয়নি দুর্বৃত্তদের বিচারও। যদি সুষ্ঠু তদন্ত- গ্রেপ্তার ও বিচার হতো, তাহলে এই দুর্বৃত্তরা আর একের পর এক সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারতো না। এমন পরিস্থিতিতে সেভ দ্য রোড-এর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি ৪ টি সুপারিশ উপস্থাপন করছি- ১. দল-মত নির্বিশেষে বাহনে অগ্নিসংযোগকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দ্রুত করার লক্ষ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিন ২. সেভ দ্য রোড-এর গত ১৬ বছর ধরে চেয়ে আসা দাবি- প্রতি ৩ কিলোমিটার অন্তর পুলিশ বুথ স্থাপন করুন ৩. অনতিবিলম্বে হাইওয়ে, নৌ, রেল ও ট্রাফিক পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত ও সক্রিয় করে গড়ে তুলুন ৪. সারাদেশে সকল ল্যাম্পপোস্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও সার্বক্ষণিক মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করুন। এই আহবানের পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- নেত্রকোনা সদর থেকে ঢাকার উদ্দেশে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন নাদিয়া আক্তার, তার দুই সন্তান, ভাই ও দেবর। মিনহাজুর রহমানের শ্বশুর বাড়ির পাঁচজনসহ সব মিলিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন নয় সদস্য। রাত সোয়া ৪টার দিকে নয়জনের মধ্যে পাঁচজন বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে যান। বাকি চারজনের নামার কথা ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যান নাদিয়া আক্তার পপি (৩৫) ও তার শিশুসন্তান ইয়াসিন (৩)। আর বাকি মামা-ভাগনে হাবিব (১৮) ও ফাহিম (৯) আগুন লাগার সময় ট্রেন থেকে বেরিয়ে যান। ১৯ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন নিহত পপির দেবর দেলোয়ার হোসেন টিটু। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন- নেত্রকোনা থেকে রাতে ঢাকার উদ্দেশে ট্রেনে ওঠেন নয়জন সদস্য। নয়জনের মধ্যে পাঁচজন বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে যান। বাকি চারজনের নামার কথা ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। আগুনে ভাবি নাদিয়া আক্তার পপি ও তার শিশুসন্তান ইয়াসিন মারা যান। আর বাকি মামা-ভাগনে হাবিব ও ফাহিম আগুন লাগার সময় ট্রেন থেকে বেরিয়ে যান। তারা বেরোনোর সময় আঘাত পেয়ে আহত হয়েছেন। টিটু আরও জানান, বিমানবন্দর স্টেশনে সবাই নেমে গেলে ভাবি ও বাচ্চাটাও বেঁচে যেত।
যতদূর জানতে পারি- ১৯ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে ট্রেনটিতে আগুন দেয় দুর্বত্তরা। এতে ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে চারজন মারা যান। তাদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে পাঠানো হয়। কমলাপুর রেলওয়ে থানার পরিদর্শক মো. ফেরদৌস বলেন, তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ঘটনাস্থলেই চারজন মারা গেছেন। তাদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল মর্গে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, নিহতদের মধ্যে নাদিয়া ও তার শিশুসন্তান ছাড়া অন্য দুজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। নাদিয়ার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। তার বাবার নাম ফজলুর রহমান। তেজগাঁও তেজকুনিপাড়ায় স্বামী মিজানুর রহমানের সঙ্গে থাকতেন তিনি। এভাবে বাংলাদেশে সহিংসতার আঘাতে জর্জরিত হোক মানুষ, তা আমরা চাই না। আর তাই চাই- সুষ্ঠু তদন্তের পথে হাঁটুক বাংলাদেশ, গ্রেপ্তার হোক আসল আসামিরা আর বিচার হোক দৃষ্টান্তমূলকভাবে... (শান্তা ফারজানা : শিক্ষক ও মহাসচিব, সেভ দ্য রোড)