শিশুরা ফুলের মতো পবিত্র। তবে সব ফুল সুসজ্জিত বাগানে থাকার সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। এদের ঠাঁই হয় রাস্তায়। যেসব শিশু মা-বাবাহীন বা মা-বাবা থাকা সত্ত্বেও খাদ্যাভাব ও নির্যাতনের শিকার হয়ে পরিবারের সঙ্গে টিকতে না পেরে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বসবাস করতে শুরু করে-এমন শিশুদের সাধারণত পথশিশু বলে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন মতে, শূন্য থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত যেসব শিশু রাস্তায় দিনাতিপাত করে, যাদের নিজেদের বা পরিবারের কোনো স্থায়ী আবাসস্থল নেই, তারাই পথশিশু। বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের একটি বড় অংশ অবহেলিত, নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অধিকাংশ পরিবার মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। যার ফলে পরিবারগুলো ঠিকমতো জীবনযাপন করতে পারেন না। কারণ, তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করতে অক্ষম। তাই পরিবারগুলো শিশুদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ফলে দেখা যায় ক্ষুধা মেটাতে অনেক শিশু নেমে পড়ে রাস্তায়। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশের মোট পথশিশুর প্রায় অর্ধেক (৪৮.৫%) ঢাকা বিভাগে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় ২২.৭ এবং ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় ১৮.৩ শতাংশের বসবাস। সবচেয়ে কম পথশিশু সিলেট বিভাগে (৪.০%)। মোট পথশিশুর ৮২ শতাংশ ছেলে, ১৮ শতাংশ মেয়ে। আর অর্ধেকের বেশি পথশিশুর বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। পথশিশুদের ১২ শতাংশই মাদকাসক্ত। এদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন থাকে, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। এক গবেষণায় দেখা যায় মূলত দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা পথশিশুতে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়া বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ বা একাধিক বিয়ে, তাঁদের মৃত্যু, পারিবারিক অশান্তি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন, নদীভাঙন, হারিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিশুরা পরিণত হয় পথশিশুতে। এরা রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্টপেজ, লঞ্চ টার্মিনাল থেকে শুরু করে শহরের ফুটপাত, ওভারব্রিজ বা পার্কগুলোতে রাত কাটায়। বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় এসব পথশিশুরা ক্ষুধার জ্বালা, একাকীত্বের কষ্ট নিবারণসহ নানা কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এই পথশিশুরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য পুষ্টিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের নেই নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ, শিশু আইনসহ দেশের প্রচলিত আইনে প্রতিটি শিশু তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ লাভের জন্য শিক্ষা, খেলাধুলা, খাদ্য ও পুষ্টি, বিনোদন পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু দেশের পথশিশুরা এসবের নাগালের বাইরে থাকছে। পথশিশুদের পুনর্বাসন এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা ও সংগঠন থাকলেও কার্যকরী পদক্ষেপের অভাবে এখনো রাস্তায় দেখা যায় এইসব পথশিশুদের। এসব শিশুদের রক্ষা করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারকে মাদকাসক্ত পথশিশুদের পুনর্বাসনের বিষয়ে কঠোর হতে হবে। পথে বসবাসকারী শিশুদের উদ্ধার করে সমাজসেবার অধীন পরিচালিত হোমগুলোতে আশ্রয় নিশ্চিত করতে হবে। যেসব পথশিশু অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আলাদা ভাবে স্কুল খুলে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বর্তমানে উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথে ধাবমান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। তাই দেশের ভবিষ্যতের জন্য পথশিশুদের শিক্ষিত করে এবং তাদের আর দশটা শিশুর মতোই বড় করে দেশের কাজে লাগাতে হবে।