‘আমার নিজের সন্তানের মতোই প্রিয় ছিল নাহিয়ান আমিন হারিস। বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেনি পর্যন্ত ওকে পড়িয়েছি। অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিল। ওকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন ঢাকার বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’ কান্নায় ভেঙে পরে কথাগুলো বলছিলেন, বরিশাল জিলা স্কুলের সাবেক শিক্ষক মিজানুর রহমান। নাহিয়ান আমিন হারিসের বাবা বাকপ্রতিবন্ধী রিয়াজুল আমিন বাবুর কান্নায় শাব্দিক ভাষা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু তার বুকভাঙা অশ্রুর স্রোত আপ্লুত করছে সবাইকে। রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকান্ডে নিহত ৪৬ জনের একজন বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের পলিটেকনিক রোডের বাসিন্দা নাহিয়ান আমিন হারিস। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্য সময়ে নাহিয়ান বাড়িতে আসলে বন্ধুরা তার সাথে আনন্দে দেখা করতে আসতেন। আজ সেই বাড়িতে আনন্দের পরিবর্তে চলছে শোকের মাতম। নাহিয়ানের মৃত্যুতে শুধু পরিবার বা স্বজন নয়; পুরো এলাকাবাসী কেঁদেছে। শনিবার দুপুরে নিহত নাহিয়ান আমিন হারিসের ফুফাতো ভাই বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ নাভিদ নূর বলেন, বেইলি রোডে অনেক নামকরা রেস্টুরেন্ট আছে। মানুষ সেখানে খেতে যায়, অনুষ্ঠান করে। অথচ ওখানে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। বাসার বাহিরে যদি আমরা নিরাপদ না হই। এটা তো কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত। তিনি আরও বলেন, নাহিয়ানের শরীরে বার্ন নেই। তাতে ধারণা করা হচ্ছে কার্বন মনোঅক্সাইডের কারণে সে মারা গেছে। এটা অসাবধানতা। যদি ভালো একটা ফায়ার এক্সিট থাকতো, তাহলে নাহিয়ানের মতো অন্যান্যরা হয়তো বেঁচে যেতো। আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, নাহিয়ানকে হারানোর মধ্যদিয়ে আমাদের একটা ফ্যামিলির অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে, দেশের ক্ষতি হয়েছে, বরিশাল জেলার ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখ্য, বরিশাল নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের পলিটেকনিক রোডের বাসিন্দা বাকপ্রতিবন্ধী রিয়াজুল আমিন বাবুর একমাত্র ছেলে নাহিয়ান আমিন হারিস। তার আরেক কন্যা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী। ২০২০ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন নাহিয়ান। ২০২২ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর বুয়েটে ভর্তি হন। তিনি বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শুক্রবার বাদ আসর নাহিয়ান আমিন হারিসের জানাজা শেষে নগরীর মুসলিম গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
ভোলার দুইজন নিহত ॥ ঢাকার বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহত নয়ন ও জুনাইদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সন্তানকে হারিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পরছেন স্বজনরা। নিহত নয়নের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নের চর কুমারিয়া গ্রামে। তিনি দিনমজুর সিরাজ উদ্দিনের ছেলে এবং দুর্ঘটনা কবলিত কাচ্চি ভাই বিরানীতে হোটেল বয় হিসেবে চাকরি করতেন। অপর নিহত জুনাইদ ভোলা শহরের পৌর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাইনুল হক হারুনের ছেলে। তিনি ঢাকার একটি ল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। শুক্রবার বাদ মাগরিব শহরের খলিফাপট্টি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জুনায়েদের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্তানে দাফন করা হয়েছে। নিহত নয়ন দূর্ঘটনার পাঁচদিন আগে বাড়ি থেকে কাজের সন্ধানে ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনদিন আগে চাকরিও পেয়েছেন সেই রেস্টুরেন্টে। তবে ভাগ্যের নির্মমতা তাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। নয়নের মা নাজমা বেগম বিলাপ করে বলেন, ছেলে ফোনে তাকে জানিয়েছে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসবে। কিন্তু তার তো আর জীবিত ফেরা হলো না। ফিরলো লাশ হয়ে। অপরদিকে একই অগ্নিকান্ডে ভোলার দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের গুপ্তগঞ্জ বাজার এলাকার বাসিন্দা শিক্ষার্থী দোলা ও মাহীর মৃত্যু হয়েছে। ভোলার বাসিন্দা হলেও তারা পরিবারের সাথে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।
ববি উপাচার্যের শোক ॥ বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী মালিহা মেহনাজের ভাই নাহিয়ান আমিনসহ নিহত সকলের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া।