মানব পাচার একটি সামাজিক ব্যাধি। যখন কোনো ব্যক্তিকে তার দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে বিক্রি বা পাচারের উদ্দেশ্যে লুকিয়ে রাখা, আশ্রয় দেওয়া, অন্য কোনভাবে সহায়তা করা হলে মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ অনুযায়ী, ‘মানব পাচার’ অর্থ কোনো ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে, বল প্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে তাঁর আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এবং টাকা-পয়সার বিনিময়ে বা অন্যকোন সুবিধা লাভের জন্য তাঁর উপর নিয়ন্ত্রণ আছে এমন কারো সম্মতি নিয়ে এবং দেশের ভিতরে বা বাইরে যৌন শোষণ, শ্রম শোষণ অথবা অন্যকোন শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে ক্রয় বা বিক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেয়া। মানব পাচার আমাদের বড় সমস্যাগুলোর একটি। অথচ এ ব্যাপারে যতটা নজর দেওয়া প্রত্যাশিত ছিল, ততটা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে মানব পাচার বেড়েই চলেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মানব পাচারের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে বঙ্গোপসাগর মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুটে পরিণত হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র লোকেরা আকর্ষণীয় চাকরির প্রস্তাবে সহজেই প্রতারিত হয়। তারা সেই প্রতারণা ধরতে না পেরে সহজেই অবৈধভাবে হয় স্থানান্তরিত। অনেক সময় মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়। দেখা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধারণ নিরীহ লোকদের ফ্রি ভিসা বা কোনো ধরনের শ্রম চুক্তিপত্র ছাড়াই ভালো চাকরি, বিয়ের সুযোগসহ নানান সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে, বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় ট্রলারে করে সমুদ্রপথে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যেমন-সৌদি আরব, লেবানন, বাহরাইন প্রভৃতি দেশে পাঠানো হয়। যদিও দেশে মানব পাচারের বিভিন্ন রকম শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ৬ ধারা অনুসারে মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ধারা ৭ অনুসারে সংঘবদ্ধ মানব পাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। কিন্তু তারপরও থেমে নেই মানব পাচার। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমান, যাদের একটি বড় অংশ যায় পাচার হয়ে। মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। মানব পাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সম্মিলিত আন্দোলন। প্রথমত দেশের ভেতরেই কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, যাতে পাচারকারী চক্র বেকারদের প্রলুব্ধ করার সুযোগ না পায়। পাশাপাশি যেসব দেশে মানব পাচারের হার বেশি, সেসব দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে মানব পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা। যারা মানব পাচারে সহায়তা করবেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে, অন্যথায় মানব পাচার বন্ধ করা সম্ভব হবেনা।