‘সারাজীবন হুনছি জেল মানে সরকারি ভাত। অথচ সাতদিনে মোর (আমার) আট হাজার চারশ’ টাকা খরচ হইছে। এরমধ্যে মেডিক্যালের সিট ভাড়াই দিয়েছি পাঁচ হাজার টাকা। বাকিটা খাবার বাবদ। কারণ জেলের মধ্যে যেই খাবার দ্যায়, তা মুখে দেওয়ার মতোন নয়।’ চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলেছেন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহিম (৬২)। জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় তিনি সাতদিন ছিলেন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে। একইভাবে সদ্য কারামুক্ত জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হারুন হাওলাদার বলেন, পারিবারিক একটি মামলায় এক মাস কারাবন্দি ছিলাম। ওই এক মাসে থাকা খাওয়া বাবদ চল্লিশ হাজার টাকা জেলখানার পিসি বইয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করেছি। অথচ আসামিদের খরচ বহন করে সরকার। তিনি আরও বলেন, মেডিক্যালে এক মাসের জন্য আট হাজার টাকা দিয়েছি। বাকি টাকা ক্যান্টিনের খাবার বিল ও পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে আসলে দেখার ঘরে দায়িত্বরতদের দিতে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে বড় করে লেখা রয়েছে- ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।’ তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্নকথা। সামনে আলোর পথ লেখা থাকলেও ভেতরের পুরোটাই যেন অন্ধকারে ভরা। প্রধান গেট থেকে দুর্নীতি শুরু হলেও শেষটা কোন পর্যন্ত তার সীমারেখা নেই। আসামিদের সাথে দেখা করতে লাগে টাকা। খাবারের দাম বাহিরের চেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি। জেলের মধ্যে যাচ্ছেতাই খাবার হওয়ায় বাধ্য হয়ে বেশি দামে ক্যান্টিন থেকে ক্রয় করে খেতে হয় বন্দিদের। এরমধ্যে যেসব বন্দিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ, তাদের জন্য বরিশাল কারাগার যেন নরক। সদ্য কারামুক্ত অসংখ্য ব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কারাগারের মধ্যে টাকা দিলে মেলে ভালো বিছানা। না দিলে থাকতে হয় বাথরুমের সামনে কিংবা ম্যাটের ইচ্ছামাফিক জায়গায়। কারাগারের ভেতরের মেডিক্যাল কক্ষে কোনো অসুস্থ আসামি থাকেনা। যাদের টাকা আছে কেবল তাদের ভাগ্যেই মেলে আরামদায়ক বিছানা। আর মেডিক্যালের বিছানা পেতে করতে হয় লবিং ও তদবির। সূত্রে আরও জানা গেছে, কারাগারের মধ্যে হাতবাড়ালেই মেলে ইয়াবা, গাঁজা ও ঘুমের ট্যাবলেট। এসবের লেনদেন হয় পিসি বইয়ের মাধ্যমে। নির্দিষ্ট কারারক্ষী ও কয়েদীদের মাধ্যমে চলে মাদক বাণিজ্য। সদ্য কারামুক্ত একাধিক আসামিরা জানিয়েছেন, মাসিক চুক্তিতে কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ড ও মেডিক্যালের কক্ষ বেচাকেনা হয় আসামি গুণে। মানুষ বেচাকেনার এ বাণিজ্যে ম্যাটদের (কয়েদী) সাথে সরাসরি জড়িত কারারক্ষী। আর মেডিক্যাল কক্ষের নিয়ন্ত্রণ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন সহকারী সার্জন। আর এসব টাকার ভাগ পান কারারক্ষী থেকে শুরু করে জেলখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সূত্রে আরও জানা গেছে, মেডিক্যাল কক্ষ ছাড়াও আমদানি-রপ্তানি ওয়ার্ডে আসামি বেচাকেনা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। সাতদিন, পনেরো দিন ও এক মাস চুক্তিতে আমদানি-রপ্তানি ওয়ার্ডে চলে আসামি বেচাকেনা। আর এই আসামি বেচাকেনার বাণিজ্য নিয়ে ম্যাটের (কয়েদী) মারামারি নিত্যদিনের ঘটনা। পাশাপাশি কারাগারের ক্যান্টিনে আসামিদের খাবারের দাম কয়েকগুণ বাড়তি রাখলেও কাউকে ভাউচার দেওয়া হয়না। এনিয়ে কথা বাড়ালে আসামিদের খাবার দেয় না ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ। পোশাক কিংবা বিছানা-চাদরের জন্যও গুনতে হয় টাকা। আর ভেতরের ক্যান্টিনে রান্না করা খাবারের দাম বাহিরের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের পরতে হয় চরম ঝামেলায়। তাই মুখ বুঝে সবকিছুই সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না বন্দিদের। সূত্রমত্রে, কারাগারে আসামিদের সাথে সাক্ষাত করা যেন আরেক দুস্প্রাপ্য বিষয়। নিয়মমাফিক স্লিপ কেটে দেখা করার জন্য আগতদের অপেক্ষা করতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। এরপর পাঁচ থেকে দশ মিনিট দেখা মেলে। সময় বেঁধে দিয়ে একসাথে শত শত বন্দিদের দেখা করার সুযোগ করায় অনেক সময় আসামি খুঁজে পাওয়া যায়না। ফলে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। তবে দুইশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা দিলে এক মুহুর্তের জন্যও অপেক্ষা করতে হয়না। বন্দি আসামি ঘুমানো থাকলেও তাকে ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসা হয়। কারাসূত্রে জানা গেছে, খাবার তালিকা অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে একজন কয়েদী ১১৬ গ্রাম ও হাজতির জন্য ৮৭ গ্রাম আটার রুটি, ১৪ গ্রাম আখের গুড়, দুপুরে কয়েদীর জন্য ২৯১ গ্রাম ও হাজতির জন্য ২৪৭ গ্রাম চালের ভাত, ডাল, সবজি এবং ২৯ গ্রাম ওজনের মাছ অথবা মাংস দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। রাতেও প্রায় একই মেন্যু। এছাড়া প্রতি মাসে ২০ দিন মাছ এবং ১০ দিন মাংস খাওয়ানোর নিয়ম রয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে আবার চারদিন গরু, একদিন খাসি এবং পাঁচদিন মুরগির মাংস খাওয়ানোর কথা। সদ্য কারামুক্ত অসংখ্য ব্যক্তিদের দাবি, খাবারের এসব মেন্যু তালিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জেলের মধ্যে খাবারের মাপ কম দেওয়াসহ অত্যন্ত নিন্মমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু কারারক্ষীদের নির্যাতনের ভয়ে কেউ তার প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। সার্বিক বিষয়ে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া বলেন, জেলখানায় খাবারের মান অনেক ভালো। মেডিক্যালের বেডে কেবল অসুস্থ বন্দি আসামিরাই থাকে। টাকা দিয়ে মেডিক্যাল কক্ষে থাকার কোন সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন থেকে বরিশাল জেলখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী সার্জন এসএম মিরাজ হোসেন মেডিক্যালের সিট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেন, মেডিক্যালে সিটের চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি। তাই যারা সিট বরাদ্দ পাচ্ছেন না তারাই এ অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার রত্না রায় বলেন, সম্প্রতি সময়ে ধারন ক্ষমতার চেয়ে বরিশাল কারাগারে দ্বিগুন বন্দি আসামি ছিলো। ওইসময় অনেক রাজনৈতিক ভিআইপি বন্দি আসামিও ছিলো। সেইসময় সকলকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী সিট দিতে অনেকটা হিমশিম খেতে হয়েছে। পরবর্তীতে যদিও তা সমাধান হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, উল্লেখিত অভিযোগের যদি কেউ একটিরও সুনিদৃষ্ট প্রমান দিতে পারেন, তাহলে অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তারপরেও প্রতিটি অভিযোগের ব্যাপারে অভ্যন্তরীনভাবে তদন্ত করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।