দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে কদিন আগেই বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। এবার বাড়ানো হচ্ছে ১০০ কিলোমিটারের অতিরিক্ত দূরত্বের সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেনের ভাড়া। মূলত ১০০ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণে রেয়াতি (ছাড়) সুবিধা বাতিলের মাধ্যমে এ ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি ট্রেনে নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত সংযোজিত কোচের ভাড়ার সঙ্গে বাড়তি চার্জ যুক্ত করার মাধ্যমেও আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কাছ থেকে এরই মধ্যে অনুমোদন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বর্ধিত ভাড়া কার্যকরের জন্য টিকিট ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত বেসরকারি অপারেটর সহজকে (জেভি) এরই মধ্যে স্টেশন টু স্টেশন বাণিজ্যিক দূরত্বের হিসাবও হস্তান্তর করা হয়েছে। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও (ম্যানুয়াল প্রক্রিয়া) ভাড়া বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাড়তি এই ভাড়ার হার আগামী ১ এপ্রিল থেকেই কার্যকর হবে। যাত্রীবাহী ট্রেনের এই ভাড়া বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে রেলের লোকসান কমানো এবং বিভিন্ন খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ মাত্র ৩০০ কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আয়ের জন্য সীমিত আয়ের মানুষের ওপর নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, রেল খাতে তো জনগণের করের অর্থে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলো। ২০১২ সালে ৫০ শতাংশ এবং ২০১৬ সাড়ে ৭ শতাংশ ভাড়াও বাড়ানো হলো। তাহলে রেলের লোকসান কমছে না কেন? সরকারের রাজস্ব আয়ের এই হাল কার দোষে? দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের আয়কর দেন না। জিডিপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আয় না বাড়লেও ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ হয়নি। দেশি বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে একের পর এক অবকাঠামো প্রকল্প করা হয়েছে। পরিকল্পনার ত্রুটি, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব প্রকল্পের ব্যয় বারবার বেড়েছে। এর ফলে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখন তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এভাবে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি, অপচয় ও লুণ্ঠন বন্ধ করা। কিন্তু তা না করে সরকার নানাভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে চাইছে। যেভাবে যাত্রী ও মালামালে ঠাসাঠাসি হয়ে যে ট্রেন চলাচল করে, তাতে কখনো লোকসান হওয়ার কথা নয়। এমনকি অবাধে তেল চুরি হয়, নষ্ট ও পুরোনো ইঞ্জিন ও বগি মেরামত করতে প্রতিবছর বাড়তি খরচ হয়। এবং রেলের প্রয়োজনীয় ও দক্ষ লোকবলের সংকট সমাধান করা হচ্ছে না। নিজস্ব সক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে না। ফলে লোকসান পুষিয়ে নেয়ার জন্য ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে, তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই রেলের ভাড়া বাড়িয়ে লোকসান কমানোর পথ পরিহার করে কীভাবে এই লোকসান কমানো যায় অথবা রেলকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যায়, সে ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কেননা এই ভর্তুকিটুকুও প্রয়োজন হবে না যদি রেলওয়ে খাতের অপচয়, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করা হয়, যদি ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন ও জনবলসংকটের সমাধান করা হয়, রেলওয়ের নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং রেলওয়ের মালিকানাধীন জমি ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়।