স্বাধীনতা যুদ্ধে মৃত্যুঞ্জয়ী শব্দসৈনিক মনোরঞ্জন ঘোষাল এর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন ঘোষাল বাংলাদেশের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী, সাংবাদিক ও সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন শব্দসৈনিক। তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকার সম্পাদক। তিনি ৬০ দশকের মাঝামাঝি সমযে শেষ পরিচয়, দেনা পাওনা, আশায় বাধে ঘর, প্রেম ও প্রয়োজন উপন্যাস লেখেন। ১৯৭৪ সালের ৭ মার্চ তার লেখা সমসায়িক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি একটি ছোট বই লেখেন, যার নাম ছিলো একান্ত আমি। এখানে বলা প্রয়োজন এ বইয়ের অধিকাংশ লেখা আব্দুল গফফার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক জনপদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো। এই বরেণ্য ব্যক্তির একটি সাদা কালো ছবি বাংলাদেশের ঢাকার জাতীয় যাদুঘরের ৩৮ নং কক্ষের দেওয়ালে ট্যাঙ্গানো আছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার জদিুকরী কণ্ঠে উজ্জীবিত হয়েছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠিত হয়েছিল দেশের মানুষ। স্বাধীন বাংলা বেতার তিনি যেমন সঙ্গিত পরিবেশন করেছেন। একই সথে তিনি কলকতা আকাশবানীতে নজরুল ও আধুনিক বাংলা গান পরিবেশন করেছেন। আগামী প্রজন্মদের জন্য জানা প্রয়োজন যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গান পরিবেশন করে তিনি ৪০ রুপি সম্মানী পেতেন এবং আকাশবানী কেন্দ্র থেকে গান পরিবেশন করে ১০৫ রুপি সন্মানী পেতেন। কলকাতার সাউথ পয়েণ্টের শিক্ষক কবি আশিষ সান্যালের বদন্যতায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে গুহশিক্ষক হিসাবে গান শিখানোর কাজ করেছেন।এবিষয়ে সাহায্য করেছিলেন,স্কটিস চার্জ কলেজের অধ্যাপক এসপি নাগ। আকাশবানীতে গান করার জন্য অভিভাবকের মতো তাকে সহায়তা করেছিলেন বিখ্যাত নজরুল সংঙ্গীত শিল্পী ও আকাশবানী কোলকাতার সঙ্গীত প্রয়োজক শ্রী বিমল ভূষণ। সে সময় আকাশবানীতে তার গান প্রচারিত হলে সাড়া পড়ে যায়। তার গান শুনে অধ্যাপক এসপি নাগের ছুটে বোন স্কুল শিক্ষিকা কাবেরি নাগ খুশি হযে মনোরঞ্জন ঘোষালকে একটি হারমনিয়াম উপহার দেন। সে হারমনিয়ামটি এখনও তিনি ব্যাবহার করেন এবং বাসায় যত্ন করে রেখেছেন।
তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক ভূষিত হয়েছেন। সংগীতে (শিল্পকলা- সংগীত) অবদান রাখার জন্য মনোরঞ্জন ঘোষালকে এ পদকে ভূষিত করা হয়েছে। পদকটি তিনি স্বর্গীয় স্ত্রী শ্রীমতি সন্ধ্যা ঘোষাল কে উৎসর্গ করেছেন। সেন্টার ফর ন্যাশনাল কালচার ড. মনোরঞ্জন ঘোষালকে স্বাধীনতা সিএনসি পদক ২০২৩ প্রদান করেছে। তাছাড়া তিনি দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন।
১৯৪৭ সালে ১মে বৃহস্পতিবার সাতক্ষিরা জেলার তালা উপজেলার গোনালি নলতা গ্রামের এক বনেদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল। পরবর্তিতে ঢাকার ৪৫ নম্বর পাটুয়াটুলীতে তার বাবার প্রকাশনা সংস্থা ইস্ট পাকিস্তান পাবলিশার্সের তিনি অবস্থান করেন এবং জগন্নাথ কলেজে ১৯৬৩ সালে লেখাপড়া শুরু করেন। তার জন্য ঢাকার শাখারী বাজারে বসবাস। ছোটবেলায় মা কমলা ঘোষালের কাছেই সংগীতের সুচনা। মায়ের গুন গুন করে মিস্টি সুরের গানে তিনি অনুপ্রেরণা পান। সে থেকে গান শেখা, তারপর ধীরে ধীরে শিল্পী হয়ে ওঠা। ছাত্র হিসেবেও তুখোড় ছিলেন তিনি। জগন্নাথ কলেজের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে এম কম ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি আদর্শ মানেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। তিনি সারা জীবন দেশের জন্য গান গেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছেন। দেশ-বিদেশের অনেক শিল্পীর সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন ও গান করেছেন।
মনোরঞ্জন ঘোষাল ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের দুঃশাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় যোগ দিয়েছিলেন বিক্ষুব্ধ শিল্পীগোষ্ঠীতে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গুলিতে তার বড় ভাই রতন কুমার ঘোষাল শহীদ হন। ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তরুণ মনোরঞ্জন। তারপর ব্রাশফায়ারের ভেতরে ৩৩ জনের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মনোরঞ্জন। পরে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনার বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে রাংড়া ভারতের মেঘালয়া হয়ে আসামের ধুবড়ি, ফকিরাবাদ, ফারাক্কা বাধ ও রবিন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন হয়ে শিয়ালদহে ২৬ ঘণ্টা ট্রেনে ঠাসাঠসির মধ্যে দাড়িয়ে গন্তব্যে পৌছান। তারপর বেহালাতে অবস্থান করেন। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে মনোরঞ্জন ঘোষাল পরিচিতি পান স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে।
মনোরঞ্জন ঘোষাল ২৫ মার্চ রাতের বর্ণনা দিয়ে বলেন, সে রাতে তিনি ছিলেন ৪৫ নম্বর পাটুয়াটুলীতে তার বাবার প্রকাশনা সংস্থা ইস্ট পাকিস্তান পাবলিশার্সের তিন তলায়। প্রখ্যাত রাজনিতিবিদ ফজলুল হক বিএসসি ও ডা: মোয়াজ্জেম হেসেনের নেতুত্বে রায়সাহেব বাজার মোড়ের রাস্তায় গাছের গুড়ি দিয়ে ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে রাত্র সাড়ে ১১ দিকে তার বাসায় ফিরে আসেন। এর ১৫-২০ মিনিট পরে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে ও ধোয়ার কুণ্ডিলী দেখতে পান। এরপর বর্বর পাকিস্থানী বাহিনি ট্যাংক নিয়ে যে সব বাড়িতে বাংলা দেশি পতকা উড়ানো ছিলো সে সমস্ত বাড়ি লখ্য করে গুলি করতে করতে এসে বাবু বাজারে পুলিশ ফাড়ির সমস্ত পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে। রাতে সেখান থেকে কয়েক দফা বের হওয়ার চেষ্টা করেও অন্যদের আপত্তির মুখে বের হতে পারেননি।পরদিন ২৬ মার্চ সকালে উঠেই তিনি চলে যান ৫১ নম্বর শাঁখারী বাজারে তাদের ভাড়া বাসায়। সেখানে বড় ভাই রতন কুমার ঘোষালের মুখে শোনেন, আগের রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা, রাজারবাগে অসংখ্য বাঙালি পুলিশ হত্যা করেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের অভিযান চলছে। এ অবস্থায় তাকে বাসায় না থাকার পরামর্শ দেন তার বাবা যামিনী ঘোষাল। বাবা তাকে বলেন, মনোরঞ্জন, তুমি বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংস্থার সঙ্গে আছো। আওয়ামী লীগের মিটিংয়ে যাও, তোমার বিপদ বেশি। খুঁজে দেখো, কয়েক দিন নিরাপদ কোথাও থাকতে পারো কিনা। দুপুরে খেয়ে বাবার কথামতো তিনি বাসা থেকে বের হন। চলে যান আরো কিছুটা গলিপথের ভেতরে ১১ নম্বর গোবিন্দলাল দত্ত লেনে তার বন্ধু কালীদাসের বাসায়। সেখান থেকে কালীদাসের ভাই শান্তিদাসসহ যান মতিঝিলে কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল ও নিশাত জুট মিলের অফিসে। তখন সেটা পরিচিত ছিল গোলক চেম্বার হিসেবে। তারা এ স্থানটিই সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে বেছে নেন। এখানে চাকরি করত কালীদাস। সন্ধ্যার আগে সেখানে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই কালীদাসের পরিচিত ভবনের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, পুরো শহরে কারফিউ জারি হয়েছে।
২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে তিনি আবারো শাঁখারীবাজারে তার বাসায় যান। বাসায় ঢোকার মুহূর্তেই তাদের প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক নলিনী রঞ্জন রায় তাকে জানান, ২৬ মার্চ রাতে তার বড় ভাই রতন কুমার ঘোষালকে বাসার দরজার সামনেই পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। বাসায় ঢুকতেই দেখলেন, বাবা-মা-বৌদি বিলাপ করে কাঁদছেন। এ অবস্থার মধ্যেও তার বাবা হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, এখন ভাইয়ের জন্য শোক প্রকাশের সময় নেই। এ টাকা নিয়ে তুমি দ্রুত ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। তোমাকেও ওরা মেরে ফেলবে। মনোরঞ্জন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারো পথে নামলেন। মুক্তিযুদ্ধে ছোট ভাই মদন মোহন ঘোষালকেও হত্যা করে পাকিস্তানিরা।
১৯৭১ সালে ৩১ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তরুণ মনোরঞ্জন। তারপর ব্রাশফায়ারের ভেতরে ৩৩ জনের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মনোরঞ্জন। লাশের ভেতর থেকে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে নিজের শরীরে কয়েকবার চিমটি কেটে টের পেয়েছিলেন, তিনি বেঁচে আছেন। আজো যখন জগন্নাথ কলেজ, জজকোর্ট ভবনের সামনে দিয়ে যান, শিহরিত হন। বারবার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চের সেই রাত, যে রাতে অবিশ্বাস্যভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন তিনি। তার নিজের ভাষায়, ছোটবেলায় একবার গ্রামে গিয়ে বাদুড়ের গায়ের গন্ধে শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। একাত্তরের ৩১ মার্চের সেই রাতে যখন লাশের স্তূপের মাঝখান দিয়ে বের হয়েছিলাম, তখনো নাকে লাগে সেই বাদুড়ের গায়ের গন্ধ। এখনো বাদুড়ের গায়ের গন্ধ মাঝেমধ্যেই শরীর গুলিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকার করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক মনোরঞ্জন ঘোষাল। ২০২৩ সালে মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এর নিকট মরণোত্তর দেহদানের প্রস্তুতকৃত অঙ্গীকারপত্র বা দলিলপত্র হস্তান্তর করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শব্দসৈনিক সাংবাদিক মনোরঞ্জন ঘোষাল। বিএসএমএমইউ র ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করায় বিশিষ্ট সাংবাদিক মনোরঞ্জন ঘোষালকে ধন্যবাদ জানান।
২০২২ সালে শুক্রবার রাত ১টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ৬১৭ নম্বর ভিআইপি কেবিনে মনোরঞ্জন ঘোষালের স্ত্রী শ্রীমতি সন্ধ্যা ঘোষাল (৭২) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার একমাত্র কন্যা ছন্দা ঘোষাল ২০২১ সালের ৬ মে মৃত্যুবরণ করেন। একমাত্র ছেলে মানবেন্দ্র ঘোষাল বর্তমানে পরিবার নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস করছেন।
ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল তার বক্তৃতায সব সময় বলেন, বাংলায় তিনটা পবিত্র শব্দ হল বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ১৯ মিনিটের ভাষণ না হলে মুক্তিযুদ্ধ হত না।আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মই হত না। আর বিশ্বব্যাপী লাল সবুজের পতাকা পতপত করে উড়তো না। তাই বাংলাদেশ নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সরাসরি জড়িত। বাঙালির মুক্তির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ খুবই আলোচিত এবং পরিচিত একটি বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। এরপর দীর্ঘদিন এক কঠিন লড়াইয়ের পর অর্জন হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীরসেনানী মনোরঞ্জন ঘোষাল ইতিহাসের উজ্বল নক্ষত্র। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার অবদান। তিনি একজন কীর্তিমান ও অসাধারণ মানুষ। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শব্দসৈনিক, সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন ঘোষালের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান চিরস্মরণীয়। (লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট)